জুয়াড়িদের দখলে পুঁজিবাজার, নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা
পুঁজিবাজারে আবারও তৎপরতা বেড়েছে জুয়াড়িদের। একাধিক সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এমন সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে, যেগুলোর কোনোটিরই মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। ২০ থেকে ২৫টি ছোট মূলধনী ও দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে মেতেছে জুয়াড়ি সিন্ডিকেটগুলো। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে দেখা গেছে, কারসাজিতে এমন সব কোম্পানির নাম রয়েছে যেগুলোর ব্যবসা বৃদ্ধি কিংবা মুনাফা বাড়েনি, ভবিষ্যতে ব্যবসা বাড়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। এছাড়া কোম্পানির কারখানা আছে তবে লোকসান অনেক, মুনাফায় ফেরারও সম্ভাবনা নেই। কারখানা তো দূরের কথা, কোম্পানির সাইন বোর্ড নেই, এমন সব কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়াচ্ছে চক্রগুলো। যা গত কয়েক মাস ধরেই অব্যাহত রয়েছে।
অনুসন্ধান দেখা গেছে, কারসাজির মাধ্যমে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম চলতি মাসেই দ্বিগুণ বাড়িয়েছে জুয়াড়িরা। আর গত দুই মাসে বাড়িয়েছে প্রায় ছয় গুণ। অস্বাভাবিক এ দাম বৃদ্ধি ক্যাসিনো ব্যবসার ধরণকেও হার মানায়। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে পুরো মার্কেটে। এ জন্য সূচকও বাড়ছে। বিষয়টিকে ইতিবাচক ধরে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
আরও পড়ুন : জুয়াড়িদের ধরতে এক বছর সময় লাগে : বিএসইসি চেয়ারম্যান
এদিকে ছোট মূলধনী ও দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে ভালো কোম্পানিগুলো। এ জন্য স্কয়ার ফার্মা ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোসহ ভালো মৌলভিক্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারে দাম গত দুই মাস ধরে কমছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে ক্রেতা সংকটে ফ্লোর প্রাইসে অবস্থান করছে এসব কোম্পানির শেয়ার।
জুয়াড়িদের দখলে যেসব কোম্পানি
ওরিয়ন ফার্মাসিটিউক্যালস, ওরিয়ন ইনফিউশন, বেক্সিমকো, বেক্সিমকো ফার্মা, রয়েল টিউলিপ সি পার্ল বিচ (সি পার্ল হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট), জুট স্পিনার্স, আইপিডিসি, সোনালী পেপার, নাহি অ্যালুমিনিয়াম, ইউনিক হোটেল, বিকন ফার্মা, বিএসইসি, ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন, আমরা টেকনোলজি, মালেক স্পিনিং, একমি ল্যাবরেটরিজ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে গত দুই মাস ধরেই চলছে কারসাজি।
অন্যদিকে নতুন করে কারসাজিতে যুক্ত হয়েছে বিডিকম অনলাইন, বিডি থাইফুড অ্যান্ড বেভারেজ, জেএমআই হসপিটাল, ইস্টার্ন হাউজিং, শাহজীবাজার পাওয়ার, জেমএমআই, ফারইস্ট লাইফ এবং ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্সের নাম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুয়াড়িদের মধ্যে একটি গ্রুপ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিজেই। ডিএসইর সার্ভিল্যান্সের এক প্রতিবেদনে ওরিয়ন ইনফিউশন, বিডি ওয়েল্ডিং, সি পার্ল হোটেলসহ বেশ কিছু কোম্পানির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে মালিক পক্ষের পাশাপাশি অন্য কোম্পানির উদ্যোক্তা ও ব্রোকার হাউজের কর্মকর্তারাও জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : এ মাসেই পুঁজিবাজারের আকার হবে ৮ লাখ কোটি টাকা
পুরো কারসাজি প্রক্রিয়ায় কলকাঠি নাড়ছে আরেকটি আলোচিত গ্রুপ। যাদের হাতে রয়েছে আইপিডিসি, সোনালী পেপার, ডেল্টা লাইফ, বিডিকম অনলাইন, নাহী অ্যালুমিনিয়াম এবং বিডিকম অনলাইনের শেয়ার।
আলোচিত এই গ্রুপ থেকে এখন সক্রিয় রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকায় আরেকটি গ্রুপ। তাদের হাতে রয়েছে, ওরিয়ন ফার্মা, শাহজীবাজার, ইউনিক হোটেল কোম্পানিসহ বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার।
এছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, ইন্ট্রাকো, আমরা টেকনোলজিস, মালেক স্পিনিং, একমি ল্যাবরেটরিজ, জেএমআই হসপিটাল এবং ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার রয়েছে আরও একটি গ্রুপের হাতে। যারা এ কারসাজিতে যুক্ত।
জুয়াড়ি কারা
গত দুই বছর ধরে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে আলোচিত বিনিয়োগকারীর নাম আবুল খায়ের হিরো। তার হাত ধরেই কারসাজি হচ্ছে বেশির ভাগ কোম্পানিতে। এ চক্রে রয়েছেন তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, মা আলেয়া বেগম, বোন কনিকা আফরোজ, ভাই মোহাম্মদ বাসার ও সাজিদ মাতবর, স্ত্রী সাদিয়া হাসানের ভাই কাজী ফুয়াদ হাসান এবং কাজী ফরিদ হাসান।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ব্যাংকার এস এম পারভেজ তমাল, মার্চেন্ট ব্যাংকার ছায়েদুর রহমান। এছাড়াও বিনিয়োগকারী সাইফ উল্লাহ ও তার ভাই এ জি মাহমুদ, জসিম উদ্দিন শারমিন আক্তার লাভলী এবং নাসির উদ্দিন প্রমুখ।
এছাড়াও রয়েছে ‘জামান’ চক্র। এ চক্রের সদস্যরা সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ফতুর হচ্ছেন।
যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭ (ই) (ভি) (৩) (২)- এর লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে ন্যূনতম এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে সর্বোচ্চ কত অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে তা নির্ধারিত নেই। অর্থাৎ কমিশন ইচ্ছা মতো জরিমানা করতে পারে।
এছাড়াও কমিশন পুঁজিবাজারের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারে। অপরাধ প্রমাণ হলে সব মুনাফা তো বটেই, এ পথে উপার্জিত সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত, জেল ও জরিমানা সবই হতে পারে। কিন্তু তার কিছু করছে না কমিশন।
পুঁজিবাজারের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্টক এক্সচেঞ্জগুলো মনে করছে, এসব কোম্পানিতে কারসাজি হচ্ছে। তাই নিয়ম রক্ষার্থে কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো মূল্য সংবেদশীল তথ্য আছে কিনা জানাতে চাওয়া হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলো স্বীকার করেনি, যে দাম বাড়ার কারণ আছে। বরং সবকটি কোম্পানি জানিয়েছে, কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।
আরও পড়ুন : মৃত্যুর ২৮ বছর পর শেয়ারের অর্থ পাচ্ছেন জাহানারা ইমাম
গত দুই মাস ধরে পুঁজিবাজারে একাধিক চক্র কারসাজি চালিয়ে আসলেও টনক নড়ছে না পুঁজিবাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের। তাই জুয়াড়ি চক্রের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থাও।
বরং ইস্যু মূল্যের নিচে থাকা কোম্পানি বসুন্ধরা পেপার মিলসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি। এর পেছনে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইপিওর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৮০ টাকা মূল্যে শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার বাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে কোম্পানিটি। ফলে শেয়ারটিতে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ সিদ্ধান্তে হতবাক বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে কারসাজি এখন ক্যাসিনোকাণ্ডকেও হার মানিয়েছে। যেখানে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে শেয়ারের কারসাজি হচ্ছে। সেখানে বিএসইসি নীরব ভূমিকা পালন করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত দ্রুত এসব কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন বন্ধ করে দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি রোজারিও ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওরিয়ন ফার্মা ও বেক্সিমকো লিমিটেডসহ কিছু আইটেমে (কোম্পানি) বাজার সেন্ট্রালাইজড হয়েছে। এগুলোর উপর ভিত্তি করে বাজারে ইনডেক্স ও ভলিউম আপ হচ্ছে। এটা খুব বাজে জিনিস, এটা বাজারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও পড়ুন : রোড শোর পর বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো
তিনি বলেন, বাজার যখন নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির দিকে যাচ্ছিল তখনই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ প্রতিটা শেয়ারেই একটা প্রকৃত মূল্য আছে। এই প্রাইসে যখন যায়, তখন সবাই বুঝতে পারে যে, কতটা ভালো আর কতটা খারাপ। সেগুলো মনিটরিং করে অবিলম্বে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাজার অন্য আইটেমের (কোম্পানি) দিকে চলে যেত। তখন বাজার আরও বিস্তৃত হতো। অতীতে তাই হয়েছে।
যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। কোনো কারণ ছাড়া যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে, স্টক এক্সচেঞ্জের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এসব কোম্পানির দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কি না তা খতিয়ে দেখা। যারাই কারসাজি চক্রে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কিছু শেয়ার দাম বৃদ্ধি ক্যাসিনোকে হার মানিয়েছে বলে মন্তব্য করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি কোম্পানির শেয়ার মাত্র ৬৬ কর্মদিবসে ৬০০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে। এই যে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা, এটা যদি কোম্পানির কাছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য থাকে তবে জানানো উচিত ছিল। কোম্পানির কাছ থেকে জানতে চাওয়া হলে কোম্পানি বলছে, তার কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। যদি তাদের কাছে মূল্য সংবেদশীল তথ্য না থাকে তাহলে কারা এ দাম বাড়াচ্ছে? তাদের অবিলম্বে ধরতে হবে। শেয়ারটির লেনদেন বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজারের প্রায় ৪০০ কোম্পানির মধ্যে যদি কেউ মনে করে ৫-৬টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে ইনডেক্স ও লেনদেন ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা কোথায়? সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো ভূমিকাই নেই।
তিনি বলেন, সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটি কারসাজি চক্রকে জরিমানা করেছে। এখন দেখছি আরেকটি চক্র কাজ করছে। এভাবে যদি একেক সময় একেকটি চক্র কাজ করে তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাবে কোথায়? কিছু দিন আগে বিমা কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ করে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
প্রমাণের অপেক্ষায় বিএসইসি
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েকটি কোম্পানির লেনদেন আমরা বেশ কিছু দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছি। প্রমাণ পেতে অপেক্ষা করতে হবে। যথাযথ প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন : পুঁজিবাজার সবজি-মাছের বাজার নয়
বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক কিছু পেলে ব্যবস্থা নিই। সেক্ষেত্রে কোনো কারসাজি প্রমাণ করতে ছয় মাস থেকে ১ বছর সময় লাগে। ততক্ষণে শেয়ার কারসাজি করে চক্রটি বেরিয়ে যায়। তারপর তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। সে জন্য বিনিয়োগকারীদের উচিত এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে সতর্ক থাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর সার্ভিল্যান্স বিভাগের কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যা দেখছি তা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের তদন্ত করতে না বললে তো আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।
যেভাবে কারসাজি হচ্ছে
২০০২ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি বিডিকম অনলাইন লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে একাধিকবার কারসাজি হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৩ মার্চ ২৩ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১৬ মার্চ কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারটির দাম বাড়িয়ে ৪৫ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত করে চক্রটি। এরপর দ্বিতীয় দফায় গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে কারসাজি শুরু হয়েছে। ওই দিন শেয়ারটির দাম ছিল ৩২ টাকা। সেখান থেকে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা বেড়ে বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) লেনদেন হয়েছে ৫৫ টাকা ৫০ পয়সাতে। যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
কোম্পানির নতুন কোনো ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়নি। এমনকি কোম্পানির কাছে দাম বৃদ্ধির কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্যও নেই। শুধু কারসাজি মাধ্যমে শেয়ারটির দাম বাড়ানো হয়েছে।
ডি ওয়েল্ডিং লিমিটেড
উৎপাদন তো দূরের কথা কারখানার অস্তিত্ব নেই, নামমাত্র কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে। এক মাস আগে শেয়ারটির দাম ছিল ২২ টাকা ১০ পয়সা। ১১ টাকা ৫০ পয়সা বেড়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয় ৩৩ টাকা ৬০ পয়সায়।
ফাইন ফুড
উৎপাদনহীন, নতুন করে উৎপাদন হবে কিংবা কোম্পানির মুনাফা বাড়বে এমন কোনো খবর নেই, তারপরও দাম বাড়ছে ফাইন ফুডের শেয়ারের। ২৮ জুলাই কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ৪২ টাকা ৮০ পয়সা। সেই শেয়ার ১১ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছে ৫৯ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ ১৭ টাকা বেড়েছে।
জুট স্পিনার্স লিমিটেড
দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ জুট স্পিনার্সের। এই কোম্পানির শেয়ার ১ সেপ্টেম্বর ছিল ১৬৪ টাকা ২০ পয়সা। সেই শেয়ার কোম্পানির কারসাজিতে ১৯ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয় ২৬৯ টাকা ১০ পয়সায়। অর্থাৎ ১৯ দিনের শেয়ারটির দাম বেড়েছে ১০৫ টাকা। অর্থাৎ কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারটির দাম বাড়াচ্ছে।
রয়েল টিউলিপ সি পার্ল
গত ৪ নভেম্বর কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছিল ৫৭ টাকা ১০ পয়সায়। সেখান থেকে ৬৮ টাকা ১০ পয়সা বেড়ে বৃহস্পতিবার সর্বশেষ লেনদেন হয় ১২৫ টাকা ২০ পয়সা।
এই শেয়ারটি মূলত কারসাজি চক্রের নজরে আসে গত ২৩ অক্টোবর থেকে। সেই সময় শেয়ারের দাম ছিল ৪৩ টাকা ৬০ পয়সা। ফলে সেখান থকে গত এক মাসে শেয়ারটি দাম বেড়েছে ৮১ টাকা ৬০ পয়সা।
জেএমআই হসপিটাল
পুঁজিবাজারে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারের দাম চলতি মাসে বেড়েছে ৫৬ টাকা। গত ৩১ মার্চ থেকে ছয় মাসে শেয়ারটির দাম বেড়েছে ১১০ টাকা ৬০ পয়সা। অর্থাৎ গত ৩১ মার্চ শেয়ারটির দাম ছিল ২২ টাকা। সেখান থেকে ২২ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১৩২ টাকা ৬০ পয়সাতে।
বাজারে সবচেয়ে আলোচিত শেয়ারের নাম ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড। এই কোম্পানির মুনাফা বাড়েনি, বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তারপরও শেয়ারটি দাম বাড়তে থাকে চলতি বছরের ২৮ জুলাই থেকে। ওই দিন শেয়ারটির দাম ছিল ১০৪ টাকা ৭০ পয়সা। সেখান থেকে ৫২০ টাকা বেড়ে গত বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সেই শেয়ারটি সর্বোচ্চ ৬২৪ টাকায় লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ দুই মাসের ৬ গুণ দাম বেড়েছে শেয়ারটির।
সম্পূর্ণ কারসাজির মাধ্যমে এ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারাও। তারপরও শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
ওরিয়ন ফার্মা
একই গ্রুপের আরেক কোম্পানি ওরিয়ন ফার্মা। এই কোম্পানির শেয়ারের দাম সেপ্টেম্বর মাসেই বেড়েছে ৫০ টাকা। গত শেয়ার ২৮ জুলাই থেকে ৭৫ টাকা ৩০ পয়সা বেড়ে ২২ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ ১৫৪ টাকা বিক্রি হয়েছে।
ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন
ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডের শেয়ারে চলতি বছরের ২৬ জুলাই থেকে ২৮ আগস্ট প্রথম দফায় কারসাজি হয়েছে। ২৬ জুলাই শেয়ারটির দাম ছিল ২০ টাকা ৩০ পয়সা, ২৮ আগস্ট সেই শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ টাকা ৭০ পয়সায়। অর্থাৎ ২৪ টাকা ৪০ পয়সা বেড়েছে।
বিকন ফার্মা
১ সেপ্টেম্বর ছিল ২৬০ টাকা ২০ পয়সা। সেখান থেকে ১১৯ টাকা বেড়ে ১৯ সেপ্টেম্বর শেয়ারটির দাম ৩৭৯ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। এই দাম ২০১০ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির গত দুই বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ইস্টার্ন হাউজিং
ইস্টার্ন হাউজিং কোম্পানির শেয়ার ২৮ জুলাই লেনদেন হয় ৫২ টাকায়। এরপর সেখান থেকে দাম বেড়ে ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয় ১০৫ টাকা ১০ পয়সায়। তার কয়েকদিন পর আবারও শেয়ারটির দাম কমে। কিন্তু এখন আবার শেয়ারটির দাম বাড়তে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার শেয়ারটির দাম ৮ টাকা ৪০ পয়সা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৯৩ টাকা ১০ পয়সায়।
বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ
বিডি থাই ফুড অ্যান্ড ভেবারেজের শেয়ারের কারসাজি শুরু হয় ৫ সেপ্টেম্বর থেকে। ৩৫ টাকা ৭০ পয়সা থেকে শেয়ারটির দাম ১৬ টাকা বেড়ে ৫১ টাকা ৭০ পয়সা বিক্রি হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর।
শাহজীবাজার পাওয়ার
২৮ আগস্ট কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ৬৮ টাকা ৪০ পয়সা। সেখান থেকে গত ২২ দিনে শেয়ারটি ৩২ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
প্রাইম টেক্সটাইল
২২ মে শেয়ারটির দাম ছিল ২৪ টাকা ২০ পয়সা। সেখান থেকে প্রায় ২১ টাকা বেড়ে ১৭ আগস্ট বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকায়। অর্থাৎ দ্বিগুণ দাম বেড়েছে।
এমআই/এসকেডি