তবুও জোড়াতালি দিয়ে তালিকাভুক্ত হচ্ছে এবি ব্যাংকের বন্ড!
সুকুক বন্ডের পর এবার এবি ব্যাংক লিমিটেডের পারপেচুয়াল বন্ডে বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ব্যাংকটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের এতটাই অনীহা যে নির্ধারিত সময়ের পর আরও চার দফায় সাবস্ক্রিপশনের সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু জমা পড়েছে প্রয়োজনের মাত্র অর্ধেক টাকার আবেদন।
প্রতিষ্ঠানটির বন্ড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে আন্ডার রাইটার হিসেবে কাজ করছে বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এখন এবি ব্যাংকের বন্ড নিচ্ছে না। তারপরও জোড়াতালি দিয়ে বন্ডটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।
আরো পড়ুন>>লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের বন্ড সাবস্ক্রিপশন সফলভাবে সম্পন্ন
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বলছে, ডেবট সিকিউরিটিজ রুলস- ২০২১ অনুসারে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের বন্ডে আন্ডার রাইটার ও বিনিয়োগকারী মিলিয়ে ৫০ শতাংশ আবেদন জমা পড়ে তাহলে আন্ডার সাবস্ক্রিপশন বা বন্ডের তালিকাভুক্তি বাতিল হবে না। অর্থাৎ, যে টাকার আবেদন জমা পড়বে সেই টাকায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। এ আইন কাভার করায় তালিকাভুক্ত হতে বাধা নেই।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের প্রতি এখন মানুষের আস্থা নেই। ব্যাংক খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা সবচেয়ে বেশি। শুধু তা-ই নয়, এর আগে ১১ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার পরও বেক্সিমকো লিমিটেডের সুকুক বন্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। এখন এ কোম্পানির বন্ডেও মানুষ আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
>>সরকারি বন্ড চালুর দিনে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন
বিএসইসির তথ্য মতে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর এবি ব্যাংক লিমিটেডকে ৬০০ কোটি টাকার পারপেচুয়াল বা মেয়াদবিহীন বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে বন্ডটি। বন্ডের অনুমোদন পাওয়ার পর ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে সাবস্ক্রিপশন শুরু করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
নির্ধারিত মেয়াদ অনুসারে সাবস্ক্রিপশন শেষ হয় ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বন্ডের সাবস্ক্রিপশনে কোনো সাড়া মেলেনি। এরপর কমিশনের কাছে চার দফায় সময় বাড়ানোর আবেদন করে কোম্পানি। সর্বশেষ সাবস্ক্রিপশন শেষ হয়েছে চলতি বছরের ৩০ মার্চ।
>>ইউসিবি ও ট্রাস্ট ব্যাংকের বন্ড অনুমোদন
প্রায় দেড় বছরে বন্ডের সাবস্ক্রিপশনে ৬০ কোটি টাকার বিপরীতে ২৪৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মোট ৩১ কোটি নয় লাখ ৩৬ টাকার জন্য আবেদন করেছে। যা প্রয়োজনের ৫১ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ আরও প্রয়োজন ছিল প্রায় ২৯ কোটি টাকার আবেদন। ফলে আন্ডার সাবস্ক্রিপশন থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এর আগে শরিয়াহ ভিত্তিক বন্ড সুকুকের ক্ষেত্রে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে আন্ডার সাবস্ক্রিপশন থেকে রক্ষা করেছে বিএসইসি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ উদ্যোগের ফলে সাবস্ক্রিপশন হয়ে সুকুক বন্ডটি বর্তমানে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত রয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের অনীহার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এবি ব্যাংকের কোম্পানি সচিব জসিম উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ও পাবলিক অফারের মাধ্যমে বন্ড ইস্যু করে ৬০০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয় কমিশন। কমিশনের অনুমোদনের পর নির্ধারিত সময়েই প্রাইভেট প্লেসমেন্টের ৫৪০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
>>ট্রেজারি বন্ডে সার্কিট ব্রেকার তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা
অন্যদিকে, পাবলিক অফারের ৬০ কোটি টাকার মধ্যে ৩১ কোটি বা ৫২ শতাংশ আবেদন জমা পড়েছে। নিয়ম অনুসারে বিনিয়োগকারী ও আন্ডার রাইটার মিলে ৫০ শতাংশ আবেদন জমা পড়লেই ইস্যু টিকে যায়। সুতরাং কোম্পানির ৫২ শতাংশ হারে যে টাকা জমা পড়েছে, সেই টাকায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার জন্য কমিশনের কাছে আবেদন জমা দিয়েছি। এখন কমিশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।
আন্ডার রাইটার কী তাহলে বন্ড কিনবে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কথাবার্তা চলছে। তারা যদি কেনে তাহলে ভালো। যদি না কেনে তা হলেও সমস্যা নেই।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তালিকাভুক্তির নিয়মে যা আছে সেভাবেই হবে। নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হবে না।
‘দেশে বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করতে কোম্পানির পক্ষ থেকে যতবার সাবস্ক্রিপশনের সময় চাওয়া হয়েছে, ততবার সময় দেওয়া হয়েছে।’
>>সুকুক বন্ডের অর্থায়নে বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব
সার্বিক বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘১১ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার পরও সুকুক বন্ডের প্রতি মানুষের আস্থার প্রতিফলন হয়নি। এটি কেনাতে হয়েছে বিনিয়োগকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রেশার ক্রিয়েট করে।’
‘সুকুক বন্ডের অভিজ্ঞতার কারণে এবি ব্যাংকের বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ নেই। শুধু বন্ডই নয়, ইক্যুইটির ক্ষেত্রেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সচেতন থাকেন না। তার কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বা আন্ডার রাইটাররা গুজব ও কারসাজির মাধ্যমে বন্ড ইক্যুইটি থেকে লাভ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে। অন্যদিকে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা গিয়ে ব্লকে পড়ে থাকবে। তারা পুঁজি ও মুনাফা কোনোটাই বের করতে পারবেন না। সে কারণে বিনিয়োগ করছেন না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা এখনও শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে চান না। কারণ, সবাই চান দিনে দিনে মুনাফা করতে। দীর্ঘমেয়াদি ফিক্সড মুনাফায় আগ্রহ নেই তাদের। এ কারণে বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ নেই, বিশেষ করে এবি ব্যাংকে তো করবেই না। কারণ, তাদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো না।’
ডিএসইর তথ্য মতে, ১৯৯৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবি ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। বর্তমানে ব্যাংকটির দুই হাজার ৯৮৩ কোটি ২২ লাখ ১০ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে। অর্থাৎ ৮৬০ কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধনের ব্যাংকটির ঋণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। ঋণগ্রস্ত হওয়ায় এ ব্যাংকের শেয়ার ও বন্ডে বিনিয়োগকারীদের সাড়া নেই।
বিনিয়োগকারীদের সাড়া না মেলায় পূর্ব নির্ধারিত ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সাবস্ক্রিপশনে প্রয়োজনীয় চার ভাগের এক ভাগও পূরণ হয়নি। এরপর তদবির করে চার দফা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছ থেকে অনুমতি নেয় কোম্পানিটি।
>>পুঁজিবাজারে লেনদেন হবে ৩ লাখ কোটি টাকার বন্ড, মুনাফা দেবে ৮ শতাংশ
কোম্পানির তথ্য মতে, নির্ধারিত সময়ে প্রথম দফায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাবস্ক্রিপশন না পাওয়ায় ২০২২ সালের ২২ মে পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ সময়ের মধ্যেও সাবস্ক্রিপশন না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় আরও তিন মাস সময় বাড়িয়ে ২২ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়। এ সময়েও বন্ডটি কেনার জন্য কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা খুঁজে পায়নি এবি ব্যাংক।
পরবর্তীতে ব্যাংকটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় দফায় গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ডটির সাবস্ক্রিপশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও কাঙ্ক্ষিত সাবস্ক্রিপশন না হওয়ায় চতুর্থবার অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।
এ সময়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ধারিত ৬০ কোটি টাকার বিপরীতে ৩১ কোটি নয় লাখ টাকার আবেদন জমা পড়েছে। নিয়ম অনুসারে আন্ডার রাইটারকে বন্ডের ২০ শতাংশ কিনতে হয়। সেই হিসাবে ৬০ কোটি টাকার ২০ শতাংশ হারে ১২ কোটি টাকার বেশি বন্ড কেনার কথা। কিন্তু আন্ডার রাইটার এখন সেই বন্ড কিনতে অনীহা প্রকাশ করছে।
এমআই/এসএসএইচ/