‘কৌশলে’ গ্রাহকের গলা চেপে ধরছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক!
৫০০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতিদিন এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা যেত। এখন নতুন নিয়ম চালু করছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। নিয়মিত বুথ ব্যবহার করতে হলে ব্যাংকে জমা রাখতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। তবে সাধারণ হিসাবে নিয়মিত এটিএম বুথ ব্যবহার করতে হলে গুনতে হবে বাড়তি চার্জ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ গ্রাহকরা।
বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) মতিঝিল ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ফাস্ট ট্র্যাকে এসেছিলেন রবিন নামের এক গ্রাহক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছেন, পাঁচ হাজার টাকার নিচে থাকলে এটিএম বুথের সুবিধা পাবে না। বিষয়টি নিশ্চিত হতে এসেছেন ফাস্ট ট্র্যাকে। তারও হিসাব রয়েছে ব্যাংকটিতে।
সাধারণ অ্যাকাউন্টে এখন ৫০০ টাকা থাকলেও ডিপোজিট প্লাসে থাকতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। এজন্য কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন গ্রাহক। বর্তমান হিসাব নম্বর, এটিএম কার্ড, চেকবই অপরিবর্তিত থাকবে। প্রতিদিন এটিএম বুথ থেকে ৮০ হাজার টাকা করে আটবার তুলতে পারবেন। মাসে যতবার প্রয়োজন এটিএম সুবিধা নিতে পারবেন। আর ৫০০ টাকার সাধারণ হিসাবে বর্তমান হিসাব নম্বর, এটিএম কার্ড, চেকবই পরিবর্তন হয়ে যাবে। প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা তুলতে পারবেন। তবে দিনে একবার এবং মাসে তিনবারের বেশি এটিএম বুথ ব্যবহার করতে পারবেন না। করলে পাঁচ টাকা বাড়তি চার্জ দিতে হবে প্রতি লেনদেনে।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এটিএম বুথ বেশি, সহজে টাকা তোলার সুবিধা আছে। এ কারণে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলি। ব্যাংকে টাকা রাখি, যখন প্রয়োজন হয় তখন তুলি। এখন তারা বলছে, এ সুবিধা পেতে হলে ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা রাখতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন এটিএম সেবা নেওয়া যাবে না। মাসে সর্বোচ্চ তিনদিন বুথ থেকে টাকা তোলা যাবে। এর বেশি সুবিধা নিতে হলে প্রতি লেনদেনে পাঁচ টাকা চার্জ কাটবে। এখন যেখানে এক টাকাও লাগে না।’
সুযোগ-সুবিধা কমানো হচ্ছে, শুধু এটা দেখলে হবে না। আরও অনেক বিষয় আছে। বিস্তারিত পরে জানাতে পারব
আবেদুর রহমান সিকদার, ডিএমডি, ডাচ-বাংলা ব্যাংক
‘অন্যান্য সেবায়ও দিতে হবে বাড়তি চার্জ। তার মানে, আমি ডাচ-বাংলায় অ্যাকাউন্ট খুলে বিপদে পড়েছি। তারা কৌশলে গলা চেপে ধরছে। এটা তো সেবার নামে হয়রানি’— বলেন ডাচ-বাংলার গ্রাহক রবিন।
আব্দুল্লাহ আবু নামের অপর এক গ্রাহক জানান, প্রতি মাসে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা ব্যাংকে রাখি। যখন টাকার প্রয়োজন হয় তখন বুথ থেকে তুলে খরচ করি। মাসশেষে অনেক সময় এক/দুই হাজার টাকা থাকে অ্যাকাউন্টে। এখন যে নিয়ম করতে যাচ্ছে তাতে এ সুবিধা আর পাব না। তাহলে তাদের ব্যাংকে কেন অ্যাকাউন্ট রাখব?
শুধু আব্দুল্লাহ আবু আর রবিন নয়, তাদের মতো অনেকেই ডাচ-বাংলার বিভিন্ন শাখায় আতঙ্কিত হয়ে আসছেন। জানতে চাচ্ছেন, নতুন নিয়মে কী হবে…, তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে।
অন্যান্য সেবায়ও দিতে হবে বাড়তি চার্জ। তার মানে, আমি ডাচ-বাংলায় অ্যাকাউন্ট খুলে বিপদে পড়েছি। তারা কৌশলে গলা চেপে ধরছে। এটা তো সেবার নামে হয়রানি
গ্রাহক রবিন, ডাচ-বাংলা ব্যাংক
নতুন নিয়মের বিষয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে গ্রাহককে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের মে মাস থেকে অধিকতর সুবিধা ও বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সেভিংস ডিপোজিট প্লাস হিসাবে রূপান্তর করতে যাচ্ছে, যেখানে আপনার বর্তমান হিসাবে এটিএম কার্ড, চেকবই অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু ন্যূনতম আমানত পাঁচ হাজার টাকা হতে হবে। আপনি ‘সেভিংস ডিপোজিট প্লাস’ হিসাবের অধিকতর সুবিধা গ্রহণ করতে না চাইলে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম সুবিধা সম্বলিত সাধারণ হিসাবে রাখতে নিকটস্থ শাখায় যোগাযোগ করুন। এক্ষেত্রে আপনার নাম আমানত ৫০০ টাকাই বহাল থাকবে। তবে এক্ষেত্রে সুবিধা কিছু কম হবে।
এদিকে মতিঝিল কর্পোরেট শাখায় দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ডিপোজিট প্লাস নামে একটি সেবা তারা চালু করতে যাচ্ছেন। তবে হেড অফিস থেকে এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
নতুন সেবার ধরন কেমন হবে— জানতে চাইলে ব্যাংকটির ওই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ গ্রাহকদের সুযোগ-সুবিধা আগের চেয়ে কিছুটা কমে যাবে। প্রতিদিন ব্যাংকের নিজস্ব এটিএম বুথের সেবা নিতে গেলেও বাড়তি চার্জ দিতে হবে।
গ্রাহকের হিসাবের বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। সেবার বিপরীতে চার্জও নিয়ে থাকে। এটা ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নীতিমালায় চলে। তবে গ্রাহককে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আর হয়রানিও করা যাবে না। যদি করে এবং এমন অভিযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসে তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব
সিরাজুল ইসলাম, মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
দৈনিক বাংলা মোড়ের পাশে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ফাস্ট ট্র্যাকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আল মামুন জানান, সেভিংস ডিপোজিট প্লাস নামের নতুন সেবা আগামী মে মাসে চালু হবে। সাধারণ অ্যাকাউন্টে এখন ৫০০ টাকা থাকলেও ডিপোজিট প্লাসে থাকতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। এজন্য কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন গ্রাহক। বর্তমান হিসাব নম্বর, এটিএম কার্ড, চেকবই অপরিবর্তিত থাকবে। প্রতিদিন এটিএম বুথ থেকে ৮০ হাজার টাকা করে আটবার তুলতে পারবেন। মাসে যতবার প্রয়োজন এটিএম সুবিধা নিতে পারবেন। আর ৫০০ টাকার সাধারণ হিসাবে বর্তমান হিসাব নম্বর, এটিএম কার্ড, চেকবই পরিবর্তন হয়ে যাবে। প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা তুলতে পারবেন। তবে দিনে একবার এবং মাসে তিনবারের বেশি এটিএম বুথ ব্যবহার করতে পারবেন না। করলে পাঁচ টাকা বাড়তি চার্জ দিতে হবে প্রতি লেনদেনে। এছাড়া প্রতি পাতা চেকবই নিতে হবে ১০ টাকায়।
তিনি আরও জানান, আগামী মে মাসে এটি কার্যকর হবে বলে জেনেছি। তার আগে কোনো সমস্যা হবে না। গ্রাহক চাইলে নতুন সুবিধা নিতে পারবেন। এছাড়া ডাচ-বাংলা ব্যাংকে যাদের সেলারি অ্যাকাউন্ট রয়েছে তাদের কোনো সমস্যা হবে না। সেবাগুলো নিয়মিত পাবেন।
এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিনকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।
পরে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আবেদুর রহমান সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ, ৪০ লাখ টাকারও হিসাব আছে। সবধরনের গ্রাহক হিসাব খুলতে পারবেন। ডিপোজিট প্লাস নামের নতুন সেবা আপডেট করা হচ্ছে। সব ব্যাংকই এ ধরনের সেবার পরিবর্তন আনে।’
এতে সাধারণ গ্রাহকদের সেবার মান আগের তুলনায় কমে যাবে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সুযোগ-সুবিধা কমানো হচ্ছে, শুধু এটা দেখলে হবে না। আরও অনেক বিষয় আছে। বিস্তারিত পরে জানাতে পারব।’
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গ্রাহকের হিসাবের বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। সেবার বিপরীতে চার্জও নিয়ে থাকে। এটা ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নীতিমালায় চলে। তবে গ্রাহককে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আর হয়রানিও করা যাবে না। যদি করে এবং এমন অভিযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসে তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকটিতে গ্রাহক সংখ্যা তিন কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। একক ব্যাংক হিসাবে দেশে সবচেয়ে বেশি এটিএম বুথের সেবা দিচ্ছে ব্যাংকটি। তাদের বুথ সংখ্যা চার হাজার ৮০৫টি।
এসআই/এমএআর/