ঢালাও সুবিধায় কাগজে-কলমে বেড়েছে পরিচালন মুনাফা
খেলাপির হাত থেকে বাঁচাতে ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় পায় গ্রাহক। একই সঙ্গে মুনাফা বাড়াতে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকেও। ফলে ঢালাও সুবিধায় সংকটের মধ্যেও বেশিরভাগ ব্যাংকে কাগজে কলমে বেড়েছে পরিচালন মুনাফা।
২০২১ সালে যে পরিমাণ ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে, তার ১৫ শতাংশ আদায় হলেই গ্রাহকের কাছ থেকে সুদ বাবদ পাওয়া অর্থের পুরোটা আয় হিসাবে দেখাতে পারবে। বিদ্যমান নিয়মে কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে লক্ষ্যের শতভাগ ঋণ আদায় হলেই তখন পুরো সুদকে আয় হিসেবে দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঢালাও সুবিধার কারণে নতুন করে ঋণ খেলাপি কম হচ্ছে। যার কারণে পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন লক্ষ করা যাচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রান্তিক (তিন মাস) ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দেয়। এর আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভায় আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। এরপর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সেই তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে জমার দেওয়ার আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানাতে পারবে না। তবে বিভিন্ন সূত্রে বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া গেছে।
শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) ব্যাংক হলিডে। ওইদিন ব্যাংকগুলো তাদের বিভিন্ন শাখা থেকে পাঠানো হিসাব একত্রিত করে বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অধিকাংশ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী বছর শেষে যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তার মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০২১ সালে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা হয়েছে দুই হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২০ সালে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল দুই হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। পূবালী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে এক হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৯৩৫ কোটি টাকা।
গেল বছর ইস্টার্ন ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২০ সালে মুনাফা ছিল ৮৭০ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৭৮০ কোটি টাকা। যা তার আগের বছর ছিল ৭৪১ কোটি টাকা। আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক সদ্য বিদায়ী বছরে পরিচালন মুনাফ করেছে ৭৫০ কোটি টাকা যা ২০২০ সালে ছিল ৬৮০ কোটি টাকা।
২০২১ সালে ৭১৭ কোটি টাকায় পরিচালন মুনাফা করেছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, গত বছর এই মুনাফা পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা। এনআরবি কামার্শিয়াল ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪৫০ কোটি টাকা যা ২০২০ ছিল ৩২৩ কোটি টাকা। সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংক মুনাফা করেছে ২১০ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল ১৫২ কোটি টাকা।
মেঘনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা যা গত বছর ছিল ৭৩ কোটি টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংক মুনাফা করেছে ১৬২ কোটি টাকা যা গত বছর ছিল ১২৫ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা যা ২০২০ সালে ছিল ৩১৭ কোটি টাকা। এনসিসি ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৭১৭ কোটি টাকা ২০২০ সাল শেষে মুনাফা করেছিল ৫৭৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে যমুনা ব্যাংক মুনাফা করেছে ৭৫০ কোটি টাকা যা ২০২০ সালে ছিল ৬৩৭ কোটি টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা তুলনামূলক কম। আলোচ্য বছর শেষে দেশের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে দুই হাজার ২০৭ কোটি টাকা। এক বছর আগে এই মুনাফার পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১৫৪ কোটি। অন্যদিকে রূপালী ব্যাংকের মুনাফা ১৫০ কোটি, এক বছর আগে যা ছিল ১৫৯ কোটি টাকা। মুনাফা কামার তালিকায় রয়েছে বছরজুড়ে আলোচিত ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। ২০২১ সালে ২৪৮ কোটি টাকা মুনাফা করে ন্যাশনাল ব্যাংক। তবে এক বছর আগে এ মুনাফা ছিল ৯২০ কোটি।
পরিচালন মুনাফার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছর ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় করোনার ধাক্কা লাগে। এতে মুনাফা কমে যায়। এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের নতুন নির্দেশনার ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা করা সহজ হয়েছে। কারণ, সাধারণত পুরো টাকা আদায় না হলে তা খেলাপি হয়ে যায়। সুদও আয় খাতে নেওয়া যায় না। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ পায়।
সব শেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবৃদ্ধি ও নীতি বিভাগ সার্কুলার জারি করে জানায়, চলতি বছর একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা তার মধ্যে ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে কেউ আর খেলাপি হবেন না। ছোট ঋণগ্রহীতাদের পাশাপাশি বড় ঋণগ্রহীতারাও এ সুবিধা পাবেন। এছাড়া চলতি বছর মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে নিয়মিত দেখানো ঋণের বিপরীতেও পুরো সুদ আয় খাতে নিতে পারবে ব্যাংক। তবে বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত দেখানো এ ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত ২ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। কিছু ব্যাংক কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। পরিচালন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনার সুফলও পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্সের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় ও পুঁজিবাজার থেকে পাওয়া মুনাফার প্রভাব বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রতিফলিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ এবং করপোরেট কর পরিশোধের পর নিট মুনাফার হিসাব হবে। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। নানা উপায়ে ব্যাংকগুলো ভালো পরিচালন মুনাফা দেখালেও সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনামূলক চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত মুনাফা খুব ভালো অবস্থায় নেই।
এসআই/আইএসএইচ