বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক, ছাড়ছেন বাজারও
টালমাটাল পুঁজিবাজারে দেশি বিনিয়োগকারীদের মতোই বিদেশিদের মধ্যে রয়েছে পুঁজি হারানোর ভয়। এ ভয়ে প্রবাসী ও বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করছেন। তারা যে শুধু ঝুঁকি কমাতেই শেয়ার বিক্রি করছেন তা নয়; বরং টাকা নিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়েই চলে যাচ্ছেন।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে প্রবাসী ও বিদেশিরা ২৮৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেন। পরের মাস নভেম্বরে তারা ৫২৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছন। অর্থাৎ অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে প্রায় দ্বিগুণ শেয়ার বিক্রি করেছেন। শুধু তাই নয়, ২০২০ সালের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়েছেন তারা।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জর (ডিএসই) চিফ অপারেটিং অফিসার ও মুখপাত্র এম সাইফুর রহমান মজুমদার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অক্টোবর কিংবা নভেম্বর নয়, গত ৬-৭ মাস ধরে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করছেন বেশি। কিন্তু কী কারণে শেয়ার বিক্রি করছেন, তা জানা নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি, বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে।
বিএসইসির রোড শোতে আমরা বড় টিম পাঠাচ্ছি, তারা কাজ করছে। আমরা নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দুবাইসহ সব দেশের প্রবাসী ও সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের পুঁজিবাজারে আসতে উদ্বুদ্ধ করছি।
বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছর শেষ হয়ে আসছে। তাই দেশি বিনিয়োগকারীদের মতোই বিদেশিরাও তাদের পোর্টফোলিও সমন্বয় করছেন। তিনি বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বিশ্বের যেকোনো পুঁজিবাজার থেকে ভালো। এখানে বিনিয়োগ করলেই ভালো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এ বাজারে বিদেশি ও প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে বিশ্বব্যাপী রোড শো করছি, ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি। এটি ঠিক হয়ে যাবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অতি মূল্যায়িত হওয়ায় বিদেশিরা তা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এর বড় কারণ হলো, পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্ব। এ কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিদেশিরা পুঁজিবাজারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতায় বাজারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান। এ কারণে তারা দেশি বড় বিনিয়োগকারীদের মতোই শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।
বিও হিসাব কমেছে ৬৬৭টি
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য মতে, চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব ছিল ২০ লাখ ১০ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ চার হাজার ৮৭৩টি। আর বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৯০ হাজার ৫০৮টি।
৩০ নভেম্বর প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৮৪১টিতে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা কমেছে ৬৬৭টি।
বাজারচিত্র
নানা চক্রের কারসাজিতে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাশাপাশি বস্ত্র, ওষুধ ও বিমা খাতসহ ছোট মূলধনী কোম্পানির শেয়ারের দাম অতি মূল্যায়িত হয়েছে। বিদেশিরা এসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের সীমারেখা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার পর থেকে টালমাটাল অবস্থায় দিন পার করছে দেশের পুঁজিবাজার।
নভেম্বরে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মোট ২২ কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সূচকের উত্থান ও পতন হয়েছে ১১ কার্যদিবস করে। এ উত্থান-পতনের বাজারে ডিএসইর প্রধান সূচক ২৯৪ পয়েন্ট কমে ছয় হাজার ৭০৩ পয়েন্টে দাঁড়ায়। লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা থেকে নেমে এক হাজার কোটি টাকার ঘরে অবস্থান করে। তাতে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি অর্থাৎ মূলধন হারান ২৩ হাজার ২৮ কোটি ৯৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
শেয়ার বিক্রির হালচাল
গত নভেম্বর মাসে ৯০ হাজার প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারী ৯৪৬ কোটি পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এর মধ্যে ৫২৯ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন তারা। বিপরীতে শেয়ার কিনেছেন ৪১৬ কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১১৩ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ কমেছে। অর্থাৎ বিদেশিরা বাজার থেকে এ টাকা তুলে নিয়েছেন।
অথচ বিশ্বব্যাপী করোনার প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের নভেম্বর মাসেও বিদেশি ও প্রবাসীরা এত শেয়ার বিক্রি করেননি। ওই মাসে তাদের লেনদেন ছিল ৪৭৬ কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে ২৩৩ কোটি দুই লাখ নয় হাজার টাকার শেয়ার কেনা হয়েছিল। বিপরীতে ২৪৩ কোটি ৮৭ লাখ চার হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি হয়েছিল। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় এ বছর দ্বিগুণের বেশি শেয়ার বিক্রি করছে বিদেশিরা।
চলতি বছরের অক্টোবরে প্রবাসী ও বিদেশিদের মোট ৩৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এর মধ্যে প্রবাসীরা ২৮৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। বিপরীতে মাত্র ৮৮ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কিনেছেন তারা। অর্থাৎ অক্টোবরে ১৯৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা তুলে নিয়েছিলেন প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
চলতি বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর- এ দুই মাসে প্রবাসী ও বিদেশিরা ৮১৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়েছেন। এ সময়ে ৫০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছেন বিদেশিরা। সব মিলে গত দুই মাসে নিট বিনিয়োগ কমেছে ৩০৯ কোটি টাকা।
বর্তমানে ডিএসইতে সাড়ে তিনশ কোম্পানি রয়েছে এর মধ্যে দেড়শ কোম্পানিতে নভেম্বর মাসে বিদেশি ও প্রবাসীদের শেয়ার ছিল। দেড়শ কোম্পানির মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটিবি) শেয়ার সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছেন বিদেশিরা, যার বাজার মূল্য ৬৭ কোটি টাকা। এরপরে রয়েছে এমএল ডাইং, বেক্সিমকো ফার্মা, আইডিএলসি ও স্কয়ার ফার্মা। বিপরীতে ব্র্যাক ব্যাংক, গ্রামীণফোন ও ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ার সবচেয়ে বেশি কিনেছেন বিদেশিরা।
বিদেশিদের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে ব্যাংক খাতের শেয়ারে। এ খাতে তালিকাভুক্ত ৩২টি প্রতিষ্ঠানের ১৭টিতে প্রতিষ্ঠানে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর মাসে ব্র্যাক ও পূবালী ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন বিদেশিরা। আল আরাফাহ, সিটি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকসহ মোট ১১টি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করেছে বিদেশিরা। পক্ষান্তরে তারা চারটি ব্যাংকের শেয়ার কেনাবেচা করেননি।
সিমেন্ট খাতের সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠানে বিদেশিরা বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করেছেন তারা। আর কিনেছেন দুটি কোম্পানির শেয়ার। সিরামিক খাতের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের চারটিতে বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশিরা দুটি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করেছেন। আর দুই কোম্পানির শেয়ার অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রকৌশল খাতে ৪২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে তারা তিনটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করেন নভেম্বর মাসে। বাকি কোম্পানিগুলোর শেয়ার অপরিবর্তিত রয়েছে। একইভাবে আর্থিক খাতের ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে ১৩টিতে। এ খাতের দুটি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা। বাকি কোম্পানিগুলোর শেয়ার সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বস্ত্র টেলিযোগাযোগসহ বেশির ভাগ খাতের শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা।
অর্থনীতিবিদদের অভিমত
বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। ফলে বাজারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিদেশিরা সন্দিহান। এছাড়াও দেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেছে। এ অবস্থায় বিদেশিদের কেউ কেউ মার্কেট ওয়াচ করছেন। আবার কেউ কেউ শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারা সেফ জোনে চলে যাচ্ছেন।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে ভালো কোম্পানির চেয়ে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি। শুধু তাই নয়, দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ভালো কোম্পানি খুব কম রয়েছে। নতুন কোম্পানি না পাওয়ায় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। তাই তারা শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। এটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ।
ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রহমত পাশা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মার্কেট পড়লে (পতন) বিদেশিরা শেয়ার কেনেন, আর বাজার উঠলে (উত্থান হলে) শেয়ার বিক্রি করে দেন।
তিনি বলেন, কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগের চেয়ে তারা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করেন। জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করেন, ১৫-২০ শতাংশ মুনাফা করেন। এখন হয়তো সে রকম কোম্পানি পাচ্ছেন না, তাই তারা বিনিয়োগ করছেন না।
এমআই/আরএইচ