করোনার পর এবার পূজা আর বন্যার অজুহাত
# দেশে পেঁয়াজ মজুত আছে ৫ লাখ টন
# প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়
# ভোক্তাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের কারসাজি
দেশে করোনা মহামারির শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছিল। সাধারণ ক্রেতাদের ধারণা ছিল সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে দাম কমবে। প্রায় এক মাস ধরে দেশে করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু নিত্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে তার কোনো প্রভাবই পড়ছে না। উল্টো আগের তুলনায় অনেক পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
গত ২০ দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০ দিন আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। আজ তা ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও দেশে প্রায় পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত থাকার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তার ভাষ্য মতে, মজুত থাকা পেঁয়াজ দিয়ে আরও অন্তত দুই-তিন মাস ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
ভোক্তাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। ভারতে বন্যার অজুহাতে পেঁয়াজ আমদানি করেও বাজারে বিক্রি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে অব্যাহতভাবে বাড়ছে পণ্যটির দাম।
যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে পেঁয়াজের ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এছাড়া পূজার কারণে বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি প্রায় বন্ধ। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারে। পেঁয়াজের দাম আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ দেখছেন না ব্যবসায়ীরা। তাদের এ কথার সঙ্গে সায় দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রীও।
প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। অথচ ১৫ থেকে ২০ দিন আগেও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০-৪৫ টাকা কেজিতে আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৩৫-৪০ টাকায়।
এদিকে করোনা মহামারির কারণে দেশে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে। যারা ব্যবসা কিংবা চাকরি করছেন তাদেরও আয় কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি বিপাকে ফেলেছে সাধারণ ক্রেতাদের।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। এছাড়া আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা কেজিতে। যদিও বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা।
বুধবার (১৩ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর একাধিক খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। অথচ ১৫ থেকে ২০ দিন আগেও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০-৪৫ টাকা কেজিতে আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৩৫-৪০ টাকায়।
খিলগাঁও বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মনির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আড়তদাররা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে। তারা বলছে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমেছে, এ অজুহাতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। তার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।
শান্তিনগর বাজারে আসা মনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মাসে বাজার খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনেই ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বাকি দিনগুলো কীভাবে চলব বুঝতে পারছি না।
তিনি বলেন, এতদিন ছেলে মেয়েদের স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। বাড়তি খরচ ছিল না। কিন্তু এখন প্রতিদিন বাড়তি খরচ হয়। এর মধ্যে সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সেলিম হোসেন বলেন, ভারতে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে পেঁয়াজের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া পূজার কারণে বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকরা ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ ওঠানো কমিয়ে দিয়েছেন। মোকামগুলোয় লোডিং কমে গেছে। তবে পূজার পর এমন দাম থাকবে না। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন জাতের পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। সেগুলো বাংলাদেশে আসলে দাম কমে যাবে।
দেশের বৃহত্তম পেঁয়াজের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী হামিদুল্লাহ মিয়া ও বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ভারতে প্রচুর পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ায় সেখানে বুকিং রেট বেড়ে গেছে। ফলে লোকসানের ভয়ে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। তাই পেঁয়াজের সরবরাহ কমেছে। আগে দিনে এক থেকে দেড় হাজার টন পেঁয়াজ এলেও এখন আসছে ৬০০-৭০০ টন।
করোনা মহামারির কারণে দেশে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে। যারা ব্যবসা কিংবা চাকরি করছেন তাদেরও আয় কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি বিপাকে ফেলেছে সাধারণ ক্রেতাদের।
গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে টিপু মুনশি বলেন, দেশে পেঁয়াজের দাম শিগগিরই কমছে না। কমপক্ষে আরও এক মাস বেশি থাকবে। নভেম্বরের শেষে বাজারে নতুন পেঁয়াজ (মুড়িকাটা) আসবে। এর আগ পর্যন্ত দাম কমবে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা চার দিক থেকে চেষ্টা করছি পেঁয়াজের দাম যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এক মাস ধরে বাড়তি দাম থাকার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত আছে, যা দিয়ে আগামী আড়াই থেকে তিন মাস চলতে পারে। তারপরও আমরা বিভিন্ন রকম শুল্ক প্রত্যাহার করার জন্য এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি।
টিপু মুনশি বলেন, ভারত ছাড়া মিয়ানমার থেকে যদি পেঁয়াজ আনা যায়, তাহলে কিন্তু এত চাপ পড়ার কথা নয়। তবে বৃষ্টিজনিত কারণে কিছুটা দাম বেড়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করব, যেন দাম সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি মোহাম্মদ আতাউল্লাহ খান বলেন, করোনা মহামারির ধাক্কায় চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে কষ্টে আছেন। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়াচ্ছে। এতে ভোক্তারা অনেকটাই দিশেহারা।
তিনি বলেন, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। পেঁয়াজ, চাল, তেল, এলপিজিসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম কমাতে কমিটি গঠন করে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের ধরে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ সেলফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, যখন সরকার নিজেই ঘোষণা দেয় যে দুই এক মাসের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম কমবে না, তখন মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা দ্রব্যের দাম আরও বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে ভোক্তারা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
জাতীয় জাগো নারী ফাউন্ডেশনের অর্থ সম্পাদক রেহেনা আকতার বলেন, দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রায়ই রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। অথচ দাম কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এদিকে কৃষকও কিন্তু ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ফলে একদিকে উৎপাদনকারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে ভোক্তারা কষ্ট পাচ্ছেন।
এমআই/এসকেডি/জেএস