ইভ্যালির গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে
ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকাসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের যে গ্রাহকরা অর্থ পরিশোধের পরও পণ্য পাননি, তাদের সে অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)।
শুক্রবার রাজধানীর তোপখানা রোডের রেল পোষ্য সোসাইটি মিলনায়তনে টিক্যাবের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ই-কমার্সের নামে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মহোৎসব : দায়টা আসলে কার?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এ আহ্বান জানানো হয়।
আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে টিক্যাবের আহ্বায়ক মুর্শিদুল হক বলেন, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের কর্ণধাররা এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বন্দি। এ অবস্থায় নিজেদের অর্থ ফিরে পাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত তাদের লাখ লাখ গ্রাহক। শুধু এ দুটি প্রতিষ্ঠানই নয়, প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে সারাদেশে একই কায়দায় লোভনীয় অফারের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কিছু কুচক্রী মহল ই-কমার্স ব্যবসার নামে লোভনীয় অফারের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মহোৎসবে মেতে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে গত দুই বছরে করোনা মহামারির কারণে ঘোষিত লকডাউনে সাধারণ মানুষ অনলাইন কেনাকাটায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগেই প্রতারক চক্রগুলো ই-কমার্সের নামে এ ধরনের প্রতারণা শুরু করে। তাদের কর্মকাণ্ডে ই-কমার্স খাতের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন হলো।
তিনি বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন সুচতুর প্রতারণা প্রকাশের পর এখন প্রশ্ন হলো, এর দায় কার? অবশ্যই এর প্রধান দায় প্রতারক চক্রের। এরপর দায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের, যারা সময়মতো তদারকি করে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আর সবশেষে কিছুটা দায় গ্রাহকদের ওপরও বর্তায়, যারা বাস্তবতা বিবেচনা না করে লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়েছেন। দায় যারই হোক, গ্রাহকরা রাষ্ট্রের নাগরিক। তারা প্রতারণার শিকার হলে তাদের ন্যায়-বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। অতীতের যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপে’র মত ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করলেও ডিজিটালাইজেশনের এ যুগ আমাদের আশান্বিত করছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুমোদিত ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে লেনদেন করেছেন গ্রাহকরা। তাদের কাছে পণ্য অর্ডার ও পেমেন্টের সম্পূর্ণ তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি তাদের কাছে নেওয়া অর্থ ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জ কী করেছে, সেটাও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সার্ভার পরীক্ষা করলে পাওয়া যাবে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের তালিকা করা, তাদের পাওনা নির্ণয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতিয়ে নেয়া অর্থ কোথায় তা বের করা ও গ্রাহকদের মাঝে সে অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন হবে বলে আমরা মনে করি না। যদি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করে গ্রাহকদের অর্থ তাদের মাঝে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়, তবে তা দেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
টিক্যাব আহ্বায়ক আরও বলেন, গ্রেফতারে আগে গ্রাহকদের প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে মালিকানা পরিবর্তনের নাটক সাজিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে ই-অরেঞ্জ। একইভাবে ইভ্যালিও দায়সহ মালিকানা পরিবর্তনের চেষ্টা করছিল বলে র্যাবকে জানিয়েছেন ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডি। বিভিন্ন সময় ফেসবুক লাইভে এসে দায়গ্রস্ত একটি প্রতিষ্ঠানের মনগড়া ব্র্যান্ডভ্যালু জাহির করা তারই প্রমাণ। ফেব্রুয়ারিতে ইভ্যালির দায় ছিল ৪০৩ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকায়। দায় মেটাতে সময় নিয়ে উল্টো দায় বাড়িয়েছে ইভ্যালি। যদিও প্রকৃতপক্ষে তাদের দায় আরও অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইভ্যালির দেখানো পথে হেঁটে অস্বাভাবিক অফার দিয়ে গ্রাহকদের টাকা লুটে নেমে পড়েছে আরও অনেক কোম্পানি। আমরা অবিলম্বে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
এ সময় টিক্যাবের পক্ষ থেকে চার দফা দাবি জানানো হয়
১) গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে আদালতের মাধ্যমে ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জে অবিলম্বে প্রশাসক নিয়োগ করে কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমান সম্পদ থেকেই গ্রাহকদের মাঝে প্রোডাক্ট ডেলিভারি ও রিফান্ড অব্যাহত রাখতে হবে।
২) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মাধ্যমে একটি বিশেষ সেল গঠন করে সহজ পদ্ধতিতে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, সিরাজগঞ্জশপ, আলেশা মার্ট, কিউকমসহ সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অভিযোগ দায়ের এবং তা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
৩) ‘ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা ২০২১’র পাশাপাশি এ খাতে শৃঙ্খলা আনা, প্রতারণা ঠেকানো ও গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষায় ‘আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।
৪) ই-কমার্স খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা টিকিয়ে রাখতে একটি আলাদা কমিশন গঠন করে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ সময় ইভ্যালির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক মীর আমির হোসেন আমু বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে আমি ইভ্যালিতে ফ্রিজ, আকাশ, মোবাইলসহ লাখেরও বেশি টাকার জিনিসপত্র অর্ডার করি। পুরো অর্থ পরিশোধের পরও আমি এখন পর্যন্ত পণ্য বা অর্থ রিফান্ড কিছুই পাইনি। ইভ্যালির অফিসে বারবার যোগাযোগের পরও এর কোনো সমাধান হয়নি। আমি আমার কষ্টের অর্থ ফেরত চাই।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মঞ্জুর হোসেন ঈসা, যুবশক্তির প্রধান উপদেষ্টা হানিফ বাংলাদেশি, টিক্যাবের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়ায়েদ উল্লাহ, মুহাম্মদ আসিফ, মো. রফিকুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন বাবু, ফারুক হোসেন প্রমুখ।
আরএইচ