ঋণের নিরাপত্তায় অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ ১১ ব্যাংক
# ১১ ব্যাংকের ঘাটতি ১৪ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা
# ঘাটতির সিংহভাগই জনতা, বেসিক, ন্যাশনাল ও অগ্রণী ব্যাংকে
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালজুড়ে ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন বিশেষ সুবিধা পুরোপুরি না থাকলেও কিস্তি পরিশোধে কিছুটা ছাড় রয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা এখনো যায়নি। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ; সেইসঙ্গে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) বা শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থ সংস্থানে ঘাটতি বেড়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যে ঋণ বিতরণ করে, তার গুণ-মান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়েছে।
জুন মাস শেষে ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। এ ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৮৭৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এছাড়া বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। জুন মাস শেষে এই ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। এ ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৮৭৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
তবে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা জুন (২০২১) প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়ায় আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ছাড়ের কারণে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে খেলাপি বাড়ায় প্রভিশন রাখা যায় না। যারা প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ আদায় কম। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। এ কারণে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে।
বেশ কয়েকটি কারণে খেলাপি বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না আবার অনেকে নতুন সুবিধার আশায়ও ঋণ শোধ করছে না। এখন ঋণ শোধ করার সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, এখন ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর একটু আগ্রহ কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তেমন চাপ দেয় না। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ব্যাংকের আয় কম তারা এসব মন্দ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে পারছে না।
খেলাপি কমলেই প্রভিশন ঘাটতি কমে যাবে উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটু চাপ দিতে হবে, যেন ব্যাংকগুলো আদায়ে তৎপর হয়। পাশাপাশি এ খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের আট দশমিক শূন্য ১৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ৪৭১ কোটি টাকার বেশি।
আলোচিত সময়ে যে ১১ ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে, তার মধ্যে সরকারি চার ব্যাংকের ঘাটতি ১১ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি জনতা ব্যাংকের। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। বেসিক ব্যাংকের তিন হাজার ৬৭১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের এক হাজার ৫২৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ৯৪৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
বেসরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৩৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের। জুন মাস শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দুই হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪৮২ কোটি ৪০ লাখ, ঢাকা ব্যাংকের ২০৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৫৯ কোটি ৬২ টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১০৩ কোটি ২২ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২১ কোটি ছয় লাখ টাকা।
কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রাখায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৭০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৫৮২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে, তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশনিং। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অ-শ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের (এসএমই) বিপরীতে সবচেয়ে কম দশমিক ২৫ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে রাখতে হয় সর্বোচ্চ, পাঁচ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি।
চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৭০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৫৮২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
এছাড়া নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ। সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে প্রভিশনিং করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।
এদিকে, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিশেষ সুযোগ নিয়ে বছরজুড়ে কিস্তি না দিয়েও যেসব ব্যাংক ঋণ খেলাপি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, ঋণের বিপরীতে এখন অতিরিক্ত এক শতাংশ প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে সেসব ব্যাংককে গত ডিসেম্বরে একটি নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
‘স্পেশাল জেনারেল প্রভিশন কোভিড-১৯’ নামের এ প্রভিশনে স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন ধরনের ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এখন তার সঙ্গে আরও ১ শতাংশ অতিরিক্ত রাখতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসআই/আরএইচ/জেএস