পুঁজিবাজার ছাড়ছেন লাখ লাখ বিওধারী
চাঙা পুঁজিবাজারেও গত এক মাসে দেড় লাখের বেশি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ হয়েছে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে আরও তিন থেকে চার লাখ বিও হিসাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তবে বিশেষজ্ঞরা এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
বিও হিসাব খোলাসহ পুঁজিবাজারের বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুন পর্যন্ত বিও হিসাব ছিল ২৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯২৮টি। গত এক মাস সাত দিনে কমেছে এক লাখ ৬১ হাজার ৭৩১টি হিসাব।
গত বুধবার (৭ জুলাই) পর্যন্ত বাজারে বিও হিসাব ছিল ২৪ লাখ ৯৬ হাজার ১৯৭টি। এর মধ্যে আট থেকে ১০ লাখ ছিল সক্রিয়, বাকি ১৪ থেকে ১৫ লাখ ছিল নিষ্ক্রিয়। নিষ্ক্রিয় হিসাবের মধ্যে সাত থেকে আট লাখ হিসাবধারী রয়েছেন যারা আইপিওতে (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) আবেদন করেন। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছয় লাখ বিওধারী বাজার ছাড়ছেন।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি কারণে বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়ছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) নতুন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে লটারি প্রথা উঠে গেছে। এখান যারাই আবেদন করছেন তারা সবাই সমহারে শেয়ার পাচ্ছেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে পুরাতন নিয়মের আইপিও ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। এ কারণে হতাশ হয়ে বাজার ছাড়ছেন অনেকে। নতুন পদ্ধতিতে আইপিওতে আবেদন করতে হলে বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থাকতে হবে। অর্থাৎ ২০ হাজার টাকার শেয়ার থাকতে হবে। পাশাপাশি আইপিওতে আবেদন করতে হলে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকার আবেদন করতে হবে।
আগে যেখানে লেনদেন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে ১০ টাকার শেয়ার সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ত, সেখানে এখন দুই সপ্তাহে ১০ টাকার শেয়ার ২০ টাকাও উঠছে না। পক্ষান্তরে আইপিও ব্যবসার চেয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসা করলে দ্বিগুণ মুনাফা পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা ১০০, ২০০ কিংবা ৫০০ বিও হিসাব ব্যবহার করে আইপিও ব্যবসা করছিলেন তারা এখন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন
এদিকে, তালিকাভুক্ত হওয়ার পর নতুন কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরুর প্রথম দিন থেকেই সার্কিট ব্রেকার আরোপ করায় শেয়ারের দাম বাড়ছে খুব ধীরে। ফলে আগে যেখানে লেনদেন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে ১০ টাকার শেয়ার সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ত, সেখানে এখন দুই সপ্তাহে ১০ টাকার শেয়ার ২০ টাকাও উঠছে না। পক্ষান্তরে আইপিও ব্যবসার চেয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসা করলে দ্বিগুণ মুনাফা পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা ১০০, ২০০ কিংবা ৫০০ বিও হিসাব ব্যবহার করে আইপিও ব্যবসা করছিলেন তারা এখন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন।
এমনই একজন বিনিয়োগকারী লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের বিও হিসাবধারী মোক্তাদির আল মামুন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন মিলে আমার ৪০টি বিও হিসাব ছিল। এর মধ্যে পাঁচটি হিসাব দিয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসা করতাম। ৩৫টি বিও দিয়ে আইপিওতে আবেদন করতাম। পাঁচ হাজার টাকা করে পৌনে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করা লাগত এখানে।
তিনি আরও বলেন, ৩৫টি বিও হিসাব দিয়ে কমপক্ষে আট থেকে ১০টি আইপিও পেতাম। চার থেকে পাঁচ হাজার শেয়ার হাতে আসত। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে ওই টাকায় এখন মাত্র ছয়টি বিও হিসাব দিয়ে আবেদন করা যাচ্ছে। শেয়ার পাচ্ছি মাত্র ১০২টি। অর্থাৎ আমার ৩৫টি হিসাব আর দরকার নেই। তাই এগুলো বন্ধ করে দেব।
একই কথা বলেন আইডিএলসির বিনিয়োগকারী মুহিত এনামুল হক। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার ১৭০টি বিও হিসাব ছিল। এগুলো দিয়ে আইপিও ধরতাম। এখন আর এগুলোর দরকার হবে না। কারণ আইপিও ব্যবসা আর নেই।
তিনি আরও বলেন, আইপিওতে ন্যূনতম ৩০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এ টাকা বিনিয়োগ করে মাত্র ১৭০টি শেয়ার পাচ্ছি। শুধু তাই নয়, আইপিওর শেয়ারের দাম আগে যেখানে এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ থেকে আট গুণ বাড়ত, এখন নতুন নিয়মে সেই শেয়ারের দাম ১৫ দিনেও অর্ধেক বাড়ে না। সময় লাগছে এক মাস। অথচ সেকেন্ডারি বাজারে একই সময়ে বিনিয়োগ করলে দ্বিগুণ লাভ করতে পারছি। সুতরাং আইপিওতে আর আবেদন করব না।
হঠাৎ করে বিও হিসাবধারীদের চলে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আইপিওর নতুন নিয়মের পাশাপাশি বিও হিসাবের বার্ষিক ফি না দেওয়ায় বেশকিছু বিও বন্ধ হচ্ছে। এটা পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। এর ফলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের চিত্র আমরা দেখতে পাব। প্রকৃত পক্ষে যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে চান তারা বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হবেন।
আইপিও ব্যবসা এতদিন কিছু বিনিয়োগকারীর হাতে ছিল বলে মনে করেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, জামানত ও ঝুঁকি ছাড়াই এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী আইপিও ব্যবসা করেছেন। নতুন নিয়মে তারা হতাশ হয়েছেন। আগের মতো তারা আইপিও শেয়ার পাচ্ছেন না, আবার দ্রুত মুনাফা তুলেও নিতে পারছেন না। তাই নিরাশ হয়ে বাড়তি বিও হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছেন।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের সঙ্গে একমত পোষণ করে ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব বিনিয়োগকারীর শত শত বিও হিসাব ছিল, তারা এসব বিও দিয়ে আইপিওতে আবেদন করতেন। এগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। এ সংখ্যা বেশ বড় অঙ্কের। তারা আইপিও শেয়ার বেশি দামে বিক্রি করে টাকা তুলে নিতেন। এর প্রভাব পড়ত সেকেন্ডারি মার্কেটে। এখন আর সেই সুযোগ নেই। ফলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা আইপিও শেয়ার পাবেন।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, নতুন পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার কোম্পানির আইপিও শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়। কোম্পানি দুটির মধ্যে সোনালী লাইফে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ১৭টি শেয়ার পান বিনিয়োগকারীরা। যা টাকার অঙ্কে ১৭০। অপর কোম্পানি বারাকা পতেঙ্গার আইপিওতে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে পাওয়া যায় ৫৪টি শেয়ার। অর্থাৎ ৫৪০ টাকার শেয়ার পান বিনিয়োগকারী।
এদিকে, পুরান পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বহুজাতিক কোম্পানি রবি আজিয়াটার আইপিওতে ১২ লাখ বিনিয়োগকারী আবেদন করেন। সেখানেও প্রতি চারজন বিনিয়োগকারীর মধ্যে একজন ৫০০ করে শেয়ার পান। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সেই শেয়ার ৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অর্থাৎ ১০ টাকার শেয়ারে ৬০ টাকা লাভ করেন বিনিয়োগকারীরা।
একইভাবে পুরাতন প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ আইপিওতে এসেছে এনআরবিসি ব্যাংক। এ কোম্পানির আইপিওতে প্রয়োজনের তুলনায় আট গুণ বেশি আবেদন জমা পড়ে। ১০ টাকা মূল্যের শেয়ার পরে ৩৯ টাকায় লেনদেন হয়।
আইপিওর নতুন পদ্ধতিতে সোনালী লাইফের বিনিয়োগকারীরা ১৭টি করে শেয়ার পেয়েছেন। লেনদেন শুরু হয় গত ৩০ জুন। এখন পর্যন্ত শেয়ারটি সর্বোচ্চ ১৬ টাকায় লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ আট দিনে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের দাম বেড়েছে ছয় টাকা। পুরাতন নিয়মে একই সময়ে শেয়ারের দাম কয়েক গুণ বেশি বাড়ত।
এমআই/এসকেডি/জেএস