চামড়ার গত বছরের দাম চান ট্যানারির মালিকরা
ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের চামড়া খাত। করোনা মহামারির মধ্যেও গেল অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে। তারপরও সামনে অনিশ্চয়তা দেখছেন ট্যানারি মালিকরা। এ কারণে গতবারের মতো এবারও কম দামে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে চান তারা।
কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ট্যানারির মালিকরা বলছেন, মহামারির আঘাত এবং দেশে দেশে লকডাউনের কারণে রফতানির বাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এছাড়া বিশ্ববাজারে চামড়ার দামও বাড়েনি। সবমিলিয়ে রফতানির বাজার খুব একটা ভালো নয়। তাই গতবার যে দামে কাঁচা চামড়া কিনেছেন সেই দামে এবারও কিনতে চান ব্যবসায়ীরা। এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দাম নির্ধারণ করতে চায় সরকার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর (জুলাই-জুন) শেষে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং এর আগের অর্থবছর থেকে প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।
সামনে বাজারের পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। এমন প্রত্যাশায় শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে ১৩১ কোটি ডলারের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।
গত বছর ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যা এর আগের বছর (২০১৯ সাল) ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যদিও এবার আগের চেয়ে রফতানি বেড়েছে। তবে করোনা ও টানা লকডাউনের কারণে এখনও ইউরোপের বাজার স্বাভাবিক হয়নি। চীনের বাজারে চামড়া রফতানির সম্ভাবনা আছে। এখন যদি চীনের নন-ট্যারিফ বাঁধাগুলো কমানো যায় তাহলে বাজার সম্প্রসারিত হবে।’
এছাড়া ভারতে আগে কিছু রফতানি হতো। লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে এখন তা বন্ধ রয়েছে। সবমিলিয়ে বাজার খুব ভালো নয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলে রফতানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আসন্ন কোরবানির প্রস্তুতি সম্পর্কে ট্যানারির এ মালিক বলেন, প্রতি বছর ব্যাংকগুলো কাঁচা চামড়া কেনার জন্য ঋণ দেয়। এবার কী পরিমাণ ঋণ দেবে তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের প্রস্তুতি। আগামী সপ্তাহে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। তখনই প্রস্তুতির কথা জানাতে পারব। কারণ, নগদ টাকা ছাড়া চামড়া কেনা যায় না।
চামড়ার দাম প্রসঙ্গে ট্যানারির মালিকদের এ নেতা বলেন, আগামী সপ্তাহে সরকার দাম বেঁধে দেবে। তবে বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম যেহেতু বাড়েনি, তাই গত বছর সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছিল, আমরা চাই এবারও সেটি থাকুক।
এদিকে, আসন্ন কোরবানি উপলক্ষে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয়ে জরুরি বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জানা যায়, বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে ওই সভায় জানানো হয়, এবারও কোরবানির কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এ দাম বেঁধে দেওয়া হবে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কেনার কারসাজি হলে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সভা থেকে এমন হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।
মহামারি করোনার এ সময়ে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং ন্যায্য দামে চামড়া বেচাকেনায় স্টেক হোল্ডারদের মতামত চেয়েছে মন্ত্রণালয়। তাদের মতামত পাওয়ার পর কোরবানির আগেই কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
এ বিষয়ে পুরান ঢাকার পোস্তার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হাজি টিপু সুলতান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সারা বছরে যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়, তার ৫০ শতাংশই আসে কোরবানিতে। প্রতি বছর দেখা যায়, কোরবানি সামনে রেখে চামড়া সংরক্ষণের প্রধান উপাদান লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। এবারও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে লবণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আগে যে লবণের বস্তা ছিল ৫৫০ টাকা, এখন তা কিনতে হচ্ছে ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়। এ বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই।’
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এ দাম বেঁধে দেওয়া হবে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কেনার কারসাজি হলে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে
চামড়ার দাম নির্ধারণের বিষয়ে তিনি বলেন, আগে আমাদের কাছে মতামত চাওয়া হতো। গত তিন বছর ধরে মতামত চাওয়া হয় না। তারা নিজেরাই দাম নির্ধারণ করেন। আমরা চাই গতবার যে দাম ছিল এবারও সেটি থাকুক। এটি থাকলে সবার জন্য সহনীয় হবে।
কোরবানির কাঁচা চামড়া কেনার জন্য নগদ ৩০০ কোটি টাকার ঋণ চেয়ে পোস্তার এ ব্যবসায়ী বলেন, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ‘র’অর্থাৎ কাঁচা চামড়া সরকারি দামে আমরা কিনি। এ সময় আমাদের নগদ টাকার প্রয়োজন হয়। সরকার ট্যানারির মালিকদের ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার মতো ঋণ দেয়। ওখান থেকে পাওনা কিছু টাকা আমরা পাব। ওই টাকায় নতুন করে চামড়া কেনা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা চাই, ব্যাংকগুলো যেন সরাসরি আমাদের ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর (২০২০ সাল) কোরবানির পশুর চমড়ার দাম আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেয় সরকার। ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যা এর আগের বছর (২০১৯ সাল) ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অন্যদিকে, খাসির চামড়া সারা দেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
২০২০-২১ অর্থবছর (জুলাই-জুন) শেষে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং এর আগের অর্থবছর থেকে প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি
এর আগে টানা কয়েক বছর কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে চলে নৈরাজ্য। পানির দামে বিক্রি হয় কাঁচা চামড়া। অনেক জেলায় চামড়া কেনার লোক না পাওয়ায় তা নষ্ট হয়। আবার অনেকে বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলে, নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। ফলে ক্ষতি হয় শত শত কোটি টাকার সম্পদ। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এতিম-মিসকিন ও গরিবরা। কারণ, ইসলামী বিধান অনুযায়ী চামড়া বিক্রির অর্থ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়। এটা তাদের ‘হক’।
এসআই/এসএম/এমএআর/