ঈদ ও লকডাউনে সুবাতাস মোবাইল ব্যাংকিংয়ে
করোনাভাইরাসের কারণে ভিড় এড়াতে ব্যাংকের শাখায় যাওয়া কমিয়েছেন গ্রাহক। ফলে অর্থ লেনদেনের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে মোবাইল ব্যাংকিং। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, সবার ক্ষেত্রেই বাড়ছে মোবাইলে লেনদেন। বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, স্কুলের বেতন-বৃত্তি ও সরকারি ভাতাসহ নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকরা ৭১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। তবে এ প্রতিবেদনে ডাক বিভাগের মোবাইল আর্থিক সেবা ‘নগদ’ এর তথ্য নেই। এ তথ্য যোগ হলে লেনদেনের পরিমাণ আরও বাড়বে।
পরিসংখ্যান বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মে মাসে লেনদেনের এ অংক একক মাস হিসেবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এর আগের মাস এপ্রিলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয় ৬৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। যা এখন পর্যন্ত একক মাস হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। গত বছরের জুলাইয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় ৬৩ হাজার কোটি টাকা। তার আগে ২০২০ সালের মে মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয় ৪৭ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মে মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয় ৪২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন কয়েকটি কারণে বেড়েছে। করোনায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও চলাচলে বিধিনিষেধের কারণে ঘরে বসে ডিজিটাল লেনদেনে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন গ্রাহক। অনেক প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেতন দিচ্ছে। মানুষ ক্রেডিট কার্ডের বিলসহ অনেক সেবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিচ্ছেন। এছাড়া সরকারের বেশকিছু পদক্ষেপ ছিল। যেমন, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আর্থিক অনুদান ও ঈদ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটাসহ বিভিন্ন কারণে লেনদেন বেড়েছে।
এ বিষয়ে এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাহামারির সময় গ্রাহক ব্যাংকের শাখায় গিয়ে লেনদেনের চেয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। এছাড়া করোনার সময়ে ক্যাশলেস লেনদেন সম্পর্কে অনেক মানুষ পরিচিত হয়েছে। এখন মানুষ কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা ও উত্তোলনের চেয়ে সহজে ঘরে বসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করছে।
তিনি জানান, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শুধু লেনদেন নয়, যুক্ত হচ্ছে অনেক নতুন নতুন সেবাও। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবা মূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রেরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংক থেকে মোবাইলে ও মোবাইল থেকে ব্যাংকেও লেনদেন করার সুবিধা পাচ্ছেন গ্রাহক। এ কারণে গ্রাহকরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকছেন।
মে মাসে লেনদেন বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে বিকাশের এ কর্মকর্তা বলেন, সবসময় ঈদের মাসে মোবাইল ফাইন্যান্সের লেনদেন বাড়ে। এবার কোভিডের কারণে অনেকে গ্রামে না গিয়ে সহজে প্রিয়জনদের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটাসহ অনেক প্রবাসী এমএফএসে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এসব কারণে মে মাসে রেকর্ড লেনদেন হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। মে মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার টাকা জমা পড়ে (ক্যাশ ইন) ১৯ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা এবং উত্তোলন (ক্যাশ আউট) হয় ১৯ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে ব্যক্তির হিসাব থেকে আরেক ব্যক্তির হিসাবে পাঠানো হয় ২১ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা।
গত মে মাসে রোজার ঈদ থাকায় ওই মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে কেনাকাটার বিলও পরিশোধ হয়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণে। ওই মাসে ৩ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা কেনাকাটা বিল পরিশোধ করেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকরা। এর আগের মাস এপ্রিলে কেনাকাটার বিল পরিশোধ ছিল ২ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।
এছাড়া মে মাসে ১ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা প্রদান, ২ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা কর্মীদের বেতন-ভাতা প্রদান, ৬৯৮ কোটি টাকা মোবাইল ফোনের রিচার্জ ও ১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধ করা হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১০ লাখ ৮৬ হাজার এজেন্ট যুক্ত রয়েছেন মোবাইল ব্যাংকিং সেবায়। নিবন্ধিত গ্রাহক ৯ কোটি ৮৬ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ৩-৪ কোটি হিসাবে প্রতিমাসে নিয়মিত লেনদেন হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দিনে পাঁচবারে ৩০ হাজার টাকা জমা করা যায়। মাসে ২৫ বারে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জমা করা যায়। আর এক দিনে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন ও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে পাঠানো যায়। এখন গ্রাহকরা ঘরে বসে এমএফএস হিসাব খুলতে পারেন।
২০১১ সালের মার্চে বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে ডাচ-বাংলা ব্যাংক এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম পরিবর্তন করে হয় ‘রকেট’। এরপর বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে ‘বিকাশ’। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি এম ক্যাশ, উপায়, মাই ক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক মোবাইলে আর্থিক সেবা দিচ্ছে। তবে বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি বিকাশের দখলে, এরপরই রকেটের অবস্থান।
এসআই/এসকেডি/জেএস