ট্রাম্পের শুল্কনীতি : ক্রয়াদেশ স্থগিতের নির্দেশনা আসছে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপ
পোশাক শিল্পে অশনি সংকেত কি
* শুল্ক বাড়ল ২২ শতাংশ, উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ
* আসছে নতুন পণ্য উৎপাদন বন্ধের বার্তা, রপ্তানিতে পড়বে বিরূপ প্রভাব
* ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে শুল্ক বেশি, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি
* শুল্কমুক্ত সুবিধার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর কষাকষির আহ্বান
পণ্য আমদানিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নিয়মে বাংলাদেশকে রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে; যা এতদিন ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। যার কারণে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশের নতুন পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার বার্তা পাঠিয়েছে।
পোশাক খাতের একাধিক শীর্ষ রপ্তানিকারক ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য জানিয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট, পিভিএইচ ও লেভি'স বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের আগের ক্রয়াদেশে দেওয়া নতুন পণ্য উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলছে। ট্রাম্পের নতুন আমদানি শুল্ক আরোপের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা। তবে, এখন পর্যন্ত সরাসরি ক্রয়াদেশ বাতিল করেনি কেউ। এ ছাড়া, একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে পোশাকের চালান ১০ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছে।
আরও পড়ুন
পোশাক কারখানার মালিকরা আরও জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের পর পরিস্থিতি কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায় আছেন ক্রেতারা। কারণ, নতুন পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন তারা। কেউ কেউ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে আরোপিত নতুন শুল্কের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে বলেছেন।
খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করছেন ক্রেতারা। শুল্কের প্রভাব নিয়ে রপ্তানিকারকরাও মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কোনও কোনও ক্রেতার পক্ষ থেকে আরোপিত নতুন শুল্ক রপ্তানিকারকদেরকেই পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ ক্রয়াদেশে চলমান উৎপাদন আপাতত স্থগিত রাখতে বলেছেন।
গত বুধবার বিকেলে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কোন দেশের ওপর কত হারে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ হবে, সংবাদ সম্মেলনে তার একটি তালিকাও তুলে ধরেন। সেসময় বাংলাদেশের বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি। এ ঘোষণার পরই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান মেইল করে তাদের দেওয়া ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। বার্তায় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ‘আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রভাব মূল্যায়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অনুগ্রহ করে কোনও নতুন উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা থেকে বিরত থাকুন।’
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক এক নেতা জানান, মার্কিন নামকরা ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্যাপ (GAP) ইতোমধ্যে পণ্য সরবরাহকারীদের অতিরিক্ত শুল্কের ব্যয় বহন করতে বলেছে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শুল্ক আরোপের কারণে ক্রয়াদেশ স্থগিতের নির্দেশনা আসছে। কিছু মালিকদের কাছে ইতোমধ্যে শুনতে পাচ্ছি— কয়েকটি বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের জন্য নতুন পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলেছে। তবে, এখন পর্যন্ত কেউ সরাসরি নাম বলতে চাচ্ছে না। সবাই সতর্কতা অবলম্বন করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অতিরিক্ত শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে। দাম বাড়লে চাহিদা কমে যাবে— এটা স্বাভাবিক। যত দ্রুত সম্ভব শুল্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। যাতে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারি।’
নতুন শুল্কহারের তালিকা অনুযায়ী— বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা উল্লেখ আছে। এ ছাড়া, কম্বোডিয়ায় ৪৯ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪৪ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ, তাইওয়ানে ৩২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩২ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডে ৩১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩০ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫ শতাংশ, জাপানে ২৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ, ইসরায়েলে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১৭ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১০ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্ক, ব্রাজিল, চিলি, এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১০ শতাংশ করে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে
মার্কিন মুলুকে প্রবেশে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে, এ সিদ্ধান্তের প্রভাব মূল্যায়ন করতে হলে প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্কের হার বিবেচনা করা জরুরি। প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের ওপর ১০ শতাংশ, ভারতের ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ৩০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ৪৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৪৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী— ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর আরোপিত শুল্কহার বাংলাদেশের তুলনায় কম। যা ভারতের জন্য কিছুটা সুবিধাজনক হতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো, মূল্যবৃদ্ধির কারণে মার্কিন ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে পারে। যার ফলে সামগ্রিকভাবে বাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের আকার ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানির সিংহভাগই তৈরি পোশাক পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এখানে বাণিজ্যের পাল্লা বাংলাদেশের দিকেই ভারী। তবে নতুন করে শুল্ক বসানোর ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। আবার বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি অনেক কম। তাই আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কটন ব্যবহারকারী ও আমদানিকারক হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই এখানে একটি চুক্তি হতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কটন দিয়ে উৎপাদিত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে হবে। এটা নিয়ে দর কষাকষি করতে পারলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।’
এসআই/এমজে