আস্থার ফুটপাতেও ভরসার ছন্দপতন, কাটছাঁটেও মিলছে না হিসাব

দুলাল মিয়া রাজধানীর বাড্ডার একটি বাড়ির কেয়ারটেকার। সেই বাড়ির নিচ তলার ছোট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। বেতন তার সবমিলিয়ে ১৫ হাজার। বেতন পেয়ে গেছেন আগেই, তবে ৬ হাজার টাকা আজই বোনাস পেয়েছেন। এই বোনাসের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। বোনাস পেয়েই বিকেলে ছুটে এলেন পরিবারের জন্য ঈদের বাজার করতে।
এ দোকান ও দোকান করে ঘুরছেন ফুটপাতে। সেময়ই কথা হয় তার (দুলাল মিয়া) সঙ্গে। আলাপকালে কিছুটা ইতস্তত বোধ করেই তুলে ধরেন নিজের অসহায়ত্বের কথা। তিনি জানান, অল্প টাকা দিয়ে পরিবারের সবার জন্য কেনাকাটা করার হিসাবটা তার মিলছে না। ভেবেছিলে ফুটপাতে কিনলে হয়তবা সবার হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আস্থার ফুটপাতে তার ভরসার ছন্দপতন ঘটেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চক্করে তার অল্প বাজেটে কাটছাঁট করেও হিসাব মেলানো যাচ্ছে না।
দুলাল মিয়া বলেন, পরিবারের জন্য শুধু জামা কাপড়, জুতা, পাঞ্জাবি কেনাকাটা করলেই হবে না, এর সঙ্গে ঈদের অন্য কেনাকাটা করার আছে। ভেবেছিলাম ফুটপাতে কম দামে সবার জন্য কেনা হয়ে যাবে, কিন্তু যে দাম এতে করে অল্প এই বাজেটে সবার জন্য কেনা যাচ্ছে না ইচ্ছে থাকলেও। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীর জন্য প্রথমে কিনলাম। এরপর বাড়িতে থাকা বাবা মা ছোট বোনের জন্যও কিনতে হবে। এছাড়া গত বছর মেয়ে বিয়ে দিয়েছি, সেই বাড়ির জন্যও কিছু কেনাকাটা করা দরকার। কিন্তু এত অল্প টাকা দিয়ে ফুটপাতেও কিনতে পারছি না। বেশ কয়জনকে কাটছাঁট করেছি, তবুও টাকার হিসাব মেলাতে পারছি না। ঈদে সবাইকে কিনে দেওয়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু এই আয়ে তা দিয়ে পারছি না।
দরজায় কড়া নাড়ছে মুসলমানদের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। ঈদে ধনি-গরিব সব শ্রেণির মানুষরাই চেষ্টা করে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের নতুন জামা কাপড় দিতে। ঈদকে সামনে রেখে সব শপিং মল জমজমাট হয়ে উঠেছে। পা ফেলানোর জায়গা নেই মার্কেটগুলোতে। এই অবস্থায় পিছিয়ে নেই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আস্থার ফুটপাতের মার্কেটও। সব ফুটপাতে ঠাসাঠাসি করে বসেছে ভ্রাম্যমাণ অস্থায়ী দোকান। জামা কাপড় থেকে শুরু করে, জুতা ব্যাগ স্যান্ডেল, প্রসাধনী সামগ্রী, নানান গহনা কিছুই বাদ নেই। সবই পাওয়া যাচ্ছে এখানে।
মার্কেটের তুলনায় ফুটপাতে তুলনামূলক কম দাম। যে কারণে নিম্নআয় ও মধ্যমআয়ের মানুষের ঢল নেমেছে ফুটপাতে। দুপুরের পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে কেনাবেচা। ফুটপাতের মার্কেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিড় জমছে নিউমার্কেটের দুপাশের ফুটপাতে, ঢাকা কলেজের সামনে, সায়েন্স ল্যাব এলাকায়, এলিফ্যান্ট রোডের দুই পাশে, গুলিস্তান, ফার্মগেট, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায়।
এছাড়াও মোহাম্মদপুর, উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মৌচাক, গুলশান বাড্ডা লিঙ্ক রোডসহ রাজধানীর প্রায় সব এলাকাগুলোতেই ফুটপাতের মার্কেট জমে উঠেছে।
এসব ফুটপাতে ভ্যান গাড়িতে করে সারি সারি দোকান বসেছে। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে শার্ট, পাঞ্জাবি, প্যান্ট, থ্রি পিস, শাড়ি, জুতা, ওড়না, কসমেটিক, গহনাসহ নানান রকমারি পণ্য। দাম মার্কেটের তুলনায় অনেক কম। সেখানে প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায়, পাঞ্জাবি ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায়, থ্রি পিস ৪০০ থেকে ৮০০ টাকায়, ব্যাগ ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায়, স্যান্ডেল ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়, জুতা ৮০০ টাকায়, শাড়ি মানভেদে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। এছাড়া কসমেটিক, গহনাসহ বিভিন্ন পণ্য মার্কেটের তুলনায় কম দামে পাওয়া যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
রাজধানীর মালিবাগ সংলগ্ন মৌচাক এলাকায় ঈদের কেনাকাটা করার জন্য এসেছেন ফরিদা খাতুন। তিনি বলেন, আমার স্বামী এবং আমি দুজনেই গার্মেন্টসে চাকরি করি। আজ সময় পেয়েছি তাই ঈদের কেনাকাটা করার জন্য এখানে এসেছি। তবে এবার ফুটপাতেও সব ধরনের জিনিসের দাম বেশি। তাই কেনাকাটাতেও এবার কিছুটা কাটছাঁট করতে হচ্ছে। আমাদের আয় কম তবুও ঈদের সময় ইচ্ছে জাগে পরিবারের সবাইকে জামাকাপড় কিনে দিই। স্বামী এবং আমার টাকা মিলে অল্প কিছু টাকা এনেছি কেনাকাটা করতে। মেয়ের জন্য একটা ড্রেস কিনেছি, ওর বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছি। কিন্তু আমার শাড়ি এখনো কিনতে পারিনি। এখনো আরও অনেক কিছু কেনার বাকি। সব মিলে বাজেটে হয়তবা হবে না। যেগুলো ভেবে এসেছিলাম কিনব, সেগুলো থেকেও হয়ত দুই তিনটা আইটেম বাদ দিতে হবে।
গুলশান বাড্ডা লিংক রোডের দুইপাশের ফুটপাতেও বসেছে প্রায় শতখানে অস্থায়ী ভ্রাম্যমাণ দোকান। এখানেও পাওয়া যাচ্ছে প্রায় সবই। এখানকার এক দোকানি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ফুটপাতের ক্রেতারা অন্য সবার থেকে আলাদা। তারা একটু নিম্নআয়ের হয়। যদিও এবার ভালো ভালো চাকরিজীবীরাও ফুটপাত থেকে কিনছে। ১৫ রোজা থেকে ভালোভাবে বিক্রি শুরু হয়েছে। এরমধ্যে গত শুক্রবার থেকে বেচা বিক্রি তুলনামূলক বেশি। অন্যান্য বারের তুলনায় এবার জিনিসের দাম একটু বেশি, কারণ আমাদের কেনাই পড়েছে বেশি। ফুটপাতের মার্কেট আসলে চলে চাঁদরাত পর্যন্ত। তাই আরও কয়েকদিন ভালোই ব্যবসা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
খোরশেদ আলম নামে এক ক্রেতা এবারের দরদাম জানিয়ে বলেন, গতবারের তুলনায় এবার একটু বেশি দাম। তারপরও আসি কিনতে, কারণ ঈদের সময় পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনাই লাগবে। এবার আমার কাছে মনে হয়েছে ফুটপাতেও বেশ ভালো কালেকশন আছে। আমিতো কিনলাম তবে অনেকে আছে যারা ফুটপাতে কিনতেও হিমশিম খাচ্ছে। সব মিলিয়ে ফুটপাতের ব্যবসাতেও সরকারের মনিটরিং থাকা উচিত।
রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর এলাকার ফুটপাতে কিনতে আসা দম্পতি রেহেনা খাতুন আর বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুল হক তাদের কেনাকাটার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমাদের আস্থা ফুটপাতেই, বড় বড় শপিং মলে অতিরিক্ত দামের কারণে কেনাকাটা করা আমাদের জন্য অসম্ভব। তবুও ফুটপাতে কেনাকাটা করতেও এবার হিমশিম খাচ্ছি। দাম এবার বেশি সবকিছুর।
দরদামের বিষয়ে জানতে চাইলে এলিফ্যান্ট রোডের ফুটপাতে প্যান্ট বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, খুব বেশি না, তবে আগের তুলনায় কিছুটা বেশি দামেই আমাদের পাইকারি মার্কেট থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। আর বছরের অন্য সময় সেভাবে ফুটপাতে সেভাবে বেচাবিক্রি হয় না। এই ঈদের সময়ের দিকেই ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে থাকে। বছরের এই সময়ের ব্যবসা দিয়েই অন্য সময়ের সাথে ব্যালেন্স করতে হয়। তাই অনেকেই এসময় এসে কিছুটা দাম বেশি নেই। যে কারণে মনে হচ্ছে দাম বেশি। আসলে খুব বেশি নয়, গতনুগতিকই আছে।
এএসএস/এমএ