‘দেশের ৬ কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও মজুরির মানদণ্ড নেই’

দেশের ৮৫ ভাগ বা প্রায় ছয় কোটি শ্রমিকের কোনো আইনি সুরক্ষা ও মজুরির মানদণ্ড নেই বলে জানিয়েছেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ।
রোববার (১২ জানুয়ারি) ধানমন্ডির কার্যালয়ে ‘শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ ও অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার উদ্যোগ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) মহাসচিব ফারুক আহমেদ, শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ শ্রমিক সংহতির সভাপতি মিজ তাসলিমা আক্তার লিমা এবং ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ।
অনুষ্ঠানে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে ৮৫ ভাগ শ্রমিক রয়েছে ইনফরমাল। ৮৫ ভাগ মানে হচ্ছে প্রায় ছয় কোটি শ্রমিক। তাদের কোনোই সুরক্ষা নেই। ওই ৮৫ ভাগ নিয়ে কাজ করছি। তাদের আইনের সুরক্ষা, মজুরির মানদণ্ড ও সামাজিক স্বীকৃতিও নেই। আমরা আইন নিয়ে যত আলোচনা করছি তার মধ্যে রয়েছে মাত্র ৫ ভাগ।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, গৃহশ্রমিক থেকে শুরু করে সচিবালয় শ্রমিকদের বিবেচনা করেন তাহলে দেখবেন বৈষম্য কতটা বেড়েছে। নির্মাণকাজে সরাসরি শ্রমিক দেখবেন না। যত শ্রমিক সব নিয়োগ দেয় ঠিকাদার, যাদের সরাসরি দেখতে পাবেন না। তাহলে তাদের অধিকার নিয়ে কিভাবে কাজ করবেন? সব মিলিয়ে আমরা খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সংস্কার করতে হবে, সে কারণে সবাইকে নিয়ে সুপারিশ তৈরি করতে চাই। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। শ্রমিক বেতন ও অধিকার পেতে কেন রাস্তায় নামতে হবে। গণমাধ্যম কর্মীদেরও মানবাধিকার কেন থাকবে না, সেটাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সুপারিশ প্রণয়নই শেষ কাজ নয়, বাস্তবায়নে মাঠে থাকতে হবে।
আলোচনায় গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পরও যাতে কমিশনের কার্যক্রম কিছুদিন অব্যাহত থাকে, সেটা আমাদের অনুরোধ থাকবে। যাতে তারা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তাদের নজরদারি রাখতে পারে। বাস্তবায়ন পর্যায়েও কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদক্ষেপ নেবে। কারণ কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো গ্রুপের চাপ রয়েছে। যারা কমিশনের রিপোর্ট এরিয়ে যেতে চাইবে কিংবা কম গুরুত্ব দেবে। সে কারণে অন্তর্বর্তী সরকার কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
অন্তর্বর্তী রিফর্ম সেল গঠনে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি আগামী এক বছর শ্রম কল্যান বছর হিসেবে ঘোষণা করে এবং সেই আলোকে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম সেভাবে বিনস্ত করে, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সহজতর হবে। সেই আলোকে আমাদের সাজেশন থাকবে শ্রমিক সংক্রান্ত যতগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে, সেখানে অন্তর্বর্তী রিফর্ম সেল গঠন করা যায় কিনা। সেই রিফর্ম সেল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মনিটরিংকাজগুলো করবে। রিফর্ম সেল গঠন করলে আমরা মনে করি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ইতিবাচক কাজ করবে। একই সঙ্গে আমরা মনে করি না যে, আমাদের উদ্যোক্তারা সব সুপারিশ বাস্তবায়নে এখনই প্রস্তুত রয়েছে। ফরমাল সেক্টরগুলোতে যারা রয়েছেন, তারা হয়ত প্রস্তুত থাকতে পারে কিন্তু ইনফরমাল সেক্টরে যারা আছেন তারা প্রস্তুত নয়।
শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য শ্রমিক নেতা মিস তাসলিমা আক্তার লিমা বলেন, শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে আমার কাছে মনে হয় যে জীবন, জীবিকা এবং জবানের অধিকার শ্রম সেক্টরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে জীবিকা এবং জবানের যে অধিকার সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আইনের বিভিন্ন দিকগুলো ধরে এবং চর্চার বিভিন্ন দিক সিপিডি উত্থাপন করেছেন। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে শ্রম শক্তির গুরুত্ব ও শ্রম শক্তির মর্যাদা সেটাকে সামনে রেখে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের কাজকে সাধারণত ছোট কাজ মনে করেন। আমরা সমাজের মধ্যে আমাদের ঘরে বাইরে প্রতিটা ক্ষেত্রে আমরা দেখি শ্রমিকদের ‘তুই’ সম্বোধন করি। যেটা অপমানকর।
তিনি বলেন, শ্রম আদালত থেকে শুরু করে হাইকোর্ট পর্যন্ত প্রত্যেকটা জায়গায় আমরা দেখি আইনের বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার থাকলেও, আপীলাত ডিভিশন থেকে শুরু করে হাইকোর্টে পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। যেটা শ্রমিকদের বোধগম্য নয়। শ্রমিকদের বুঝার জন্য বাংলা ভাষার সহজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। সংবিধান শ্রমিকের অধিকার দিলেও আইনের মারপ্যাঁচে আটকে আছে।
প্রসঙ্গত, শ্রম আইন সংশোধন ও শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি এবং শ্রমিকদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় দেশের শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনের আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সুপারিশ ও প্রস্তাবনা জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
আরএম/এমএ