মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় বিপ্লব, গ্রাহক ১৫ কোটি
ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন আলমগীর। বাড়ি বগুড়ায়। হঠাৎ ফোন আসে ছোট ভাইয়ের। জানান, বাবা অসুস্থ, শহরের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। টাকা যা ছিল খরচ হয়ে গেছে, এখন আরও টাকা লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে আলমগীর কাছের মোবাইল এজেন্টের দোকানে গিয়ে বললেন, ‘ভাই দ্রুত তিন হাজার টাকা এ নাম্বারে পাঠান’। কয়েক মিনিট পর ছোট ভাই ফোন করে জানালেন টাকা পেয়েছেন।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কল্যাণে এখন নির্দিষ্ট কোনো সময়ে নয়, বরং দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই অর্থ লেনদেন করতে পারছেন মানুষ। ১০ বছর আগে এমন ঘটনা ছিল স্বপ্নের মতো। এখন সেই স্বপ্ন পূরণ করছে বিকাশ, রকেট ও এম ক্যাশ, শিওর ক্যাশ, নগদের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলো। তাৎক্ষণিক শহর কিংবা গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর— সর্বত্রই টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বিপ্লব ঘটেছে।
মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর জন্য নয়, দৈনন্দিন প্রয়োজনে অনেক ছোট ছোট লেনদেনেও ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু পরিষেবা যেমন- বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, স্কুলের বেতন, বৃত্তির টাকা উত্তোলন, বাস, ট্রেন থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট ক্রয়, সরকারি ভাতা উত্তোলন, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইলে রিচার্জ, অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম এখন মোবাইল ব্যাংকিং।
বর্তমানে ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। গত মার্চ মাস পর্যন্ত এ সেবার গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ কোটি ২৮ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক তিন কোটি ৪৬ লাখ। দেশজুড়ে এ সেবা দিতে এজেন্ট রয়েছে ১০ লাখ ৭০ হাজার। মার্চে গড়ে দৈনিক লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। ব্যাংক ছাড়াও মোবাইলে আর্থিক সেবার বড় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’। বর্তমানে তাদের নিবন্ধিত গ্রাহক চার কোটি ৪৫ লাখ। সবমিলিয়ে দেশে মোবাইলের আর্থিক সেবার গ্রাহক সংখ্যা ১৫ কোটিতে পৌঁছেছে
এছাড়া ব্যাংকের লেনদেনও করা যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে। খুব সহজে ব্যাংক হিসাব বা কার্ড থেকে টাকা আনা যাচ্ছে মোবাইল হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে। ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেওয়া সুযোগ রয়েছে। এভাবে গ্রাহকের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে ব্যাংকিং সেবা। ফলে বাড়ছে হিসাবধারীর সংখ্যা, সঙ্গে লেনদেনও।
২০১১ সালের মার্চে বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংক এ সেবা চালু করে। পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘রকেট’। এরপর বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে ‘বিকাশ’। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি এম ক্যাশ, উপায়, মাই ক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে বাজারের বেশিরভাগ অর্থাৎ ৭০ শতাংশের বেশি গ্রাহক বিকাশের, এরপরই রকেটের অবস্থান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। গত মার্চ মাস পর্যন্ত এ সেবার গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ কোটি ২৮ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক তিন কোটি ৪৬ লাখ। দেশজুড়ে এ সেবা দিতে এজেন্ট রয়েছে ১০ লাখ ৭০ হাজার। মার্চে গড়ে দৈনিক লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক ছাড়াও মোবাইলে আর্থিক সেবার বড় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’। ২০১৯ সালের মার্চে চালু হওয়া প্রতিষ্ঠানটির এ সেবা দুই বছরে বড় বাজার দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে তাদের নিবন্ধিত গ্রাহক চার কোটি ৪৫ লাখ। নগদে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে দেশে মোবাইলের আর্থিক সেবার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটিতে পৌঁছেছে। যেখানে দৈনিক লেনদেন আড়াই হাজার কোটি টাকা।
‘এক দশকে এমএফএস সেবা মানুষের আস্থা অর্জন করে নিয়েছে’— এমন মন্তব্য করে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ১০ বছর আগে যাত্রা শুরু করায় মোবাইলভিত্তিক ডিজিটাল আর্থিক সেবার ওপর মানুষের আস্থা জন্মাতে শুরু করে। বিকাশ শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সব নীতিমালা ও কমপ্লায়েন্স পরিপূর্ণভাবে মেনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব শ্রেণির মানুষের আর্থিক লেনদেন আরও সহজ ও নিরাপদ এবং তাৎক্ষণিক ও খরচ সাশ্রয়ী করে তোলে। বিকাশের বৈচিত্রময় ও গুণগত মানের সেবার কল্যাণে এখন টাকা পাঠানোর সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে ‘বিকাশ’।”
তিনি বলেন, মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবায় দেশের মানুষের জীবন সহজ করেই বিকাশ এখন পাঁচ কোটি ২০ লাখ গ্রাহকের পরিবার। এ সেবার মাধ্যমে কেবল গ্রাহক নয়; এজেন্ট, ডিস্ট্রিবিউটর, মার্চেন্টসহ কোটি মানুষের/পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থাও হয়েছে। কেবল দেশেই নয়, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অবদান রাখা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বদরবারেও বাংলাদেশের সফলতার উদাহরণ তৈরি করেছে। করোনাকালে মানুষের জীবন সচল রাখতে বিকাশের ভূমিকা ছিল অনন্য।
কামাল কাদীর বলেন, অর্থ স্থানান্তর অথবা বিল নিষ্পত্তি অথবা পরিশোধের ক্ষেত্রে মোবাইল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে লেনদেনের ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে বিকাশ অর্থনীতির নৈপুণ্য বাড়িয়েছে। পাশাপাশি আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাংকের চেয়ে এমএফএস এগিয়ে গেছে, যার বেশিরভাগ অবদানই বিকাশের। এছাড়া ব্যাংকের তুলনায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এমএফএস অ্যাকাউন্ট থাকার হারও অনেক বেশি। বিকাশের এ সাফল্যের পেছনে মূলত চারটি বিষয় রয়েছে। সেগুলো হলো- বিনিয়োগের গুণগত মান, প্রযুক্তি, বিতরণ নেটওয়ার্ক ও কমপ্লায়েন্স।
চলতি বছরের মার্চে এমএফএসে রেমিট্যান্স সংগ্রহ হয়েছে ১৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুই হাজার ২১৯ কোটি টাকার বেতন-ভাতা বিতরণ হয়েছে। সেবার বিল পরিশোধ হয়েছে ৯৪০ কোটি টাকার। এক হাজার ৯৫৬ কোটি টাকার কেনাকাটার বিল পরিশোধ হয়েছে
এ বিষয়ে নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল লেনদেনে মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সে কারণে লেনদেনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে এটিকে গ্রহণ করছে মানুষ। মূলত ‘নগদ’ বাজারে আসার পর নতুন নতুন প্রযুক্তি এ সেবায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাতে একদিকে নতুন গ্রাহক যেমন সহজে এ সেবা গ্রহণ শুরু করতে পারছেন, তেমনি সেবার খরচ কমেছে এবং সেবার পরিসরও বেড়েছে। ফলে এমএফএস খাতে একটা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, দেশে ক্যাশলেস লেনদেন নিশ্চিত করতে সামগ্রিকভাবে এমএফএস হবে প্রধান মাধ্যম, যেখানে ‘নগদ’ নেতৃত্ব দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে এমএফএসে রেমিট্যান্স সংগ্রহ হয়েছে ১৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুই হাজার ২১৯ কোটি টাকার বেতন-ভাতা বিতরণ হয়েছে। সেবার বিল পরিশোধ হয়েছে ৯৪০ কোটি টাকার। এক হাজার ৯৫৬ কোটি টাকার কেনাকাটার বিল পরিশোধ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দিনে পাঁচবারে ৩০ হাজার টাকা জমা করা যায়। আর মাসে ২৫ বারে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা। একদিনে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন এবং ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে পাঠানো যায়। শুরুতে এজেন্টের মাধ্যমে হিসাব খুলতে হলেও এখন গ্রাহকরা ঘরে বসে এমএফএস হিসাব খুলতে পারছেন।
এদিকে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ৫ এপ্রিল থেকে চলমান কঠোর বিধিনিষেধে মোবাইলে মাসে ৪০ হাজার টাকা চার্জবিহীন লেনদেনের সুযোগ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআই/এসএসএইচ/এমএআর