সরগরম হচ্ছে পোস্তার চামড়ার আড়ত
আল্লার সন্তুষ্টির আশায় পশু কোরবানি দেবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সেই কোরবানির পশুর চামড়া কিনে সংরক্ষণের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন লালবাগের পোস্তার আড়তদাররা। পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় জবাই হওয়া পশুর চামড়া কেনার পরিকল্পনা করেছেন। এজন্য তারা নিজের পুঁজির পাশাপাশি ধার-দেনা করে শত শত কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন।
শনিবার (১৫ জুন) রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ আড়তে ব্লিচিং পাউডার ও পানি দিয়ে ধুয়ে-মুছে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জায়গা পরিষ্কার করা হচ্ছে। পুরনো চামড়া সরিয়ে আড়তগুলোতে শত শত লবণের বস্তা সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। অতিরিক্ত লবণ রাখার জন্য আড়তের ভেতরে ফাঁকা জায়গাও রাখা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছর গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার পশুর সংখ্যা বেড়েছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি। কোরবানি যোগ্য পশুর মধ্যে ৫২ লাখ ৬৮৪টি গরু, ১ লাখ ৬০ হাজার ৩২০টি মহিষ, ছাগল ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ৫৮টি, ভেড়া ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৩টি। ১৮৫০টি পশু অন্য প্রজাতিসমূহের। এ বছর বিভাগীয় পর্যায়ের তথ্যানুযায়ী, কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর সর্বোচ্চ সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৭ লাখ ২ হাজার ৩৯৪টি।
আরও পড়ুন
পোস্তার চামড়া ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, সারা বছরের চামড়ার প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশই আসে কোরবানি দেওয়া পশু থেকে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনেন তারা। ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত চলে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কার্যক্রম। তাই এ ঈদকে ঘিরে তাদের বাড়তি প্রস্তুতি রাখতে হয়। কোরবানির ঈদের দিন সকাল থেকেই চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। তার এক সপ্তাহ আগে আড়ত পরিষ্কার, লবণ সংগ্রহ এবং শ্রমিকদের প্রস্তুত করেন পোস্তার আড়তদাররা।
পোস্তার ব্যবসায়ীরা জানান, পশুর চামড়া ছাড়ানোর ৪ থেকে ৯ ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিয়ে তা সংরক্ষণ করতে হয়। না হলে ওই চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। তাই এ বছর চামড়া সংরক্ষণের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন আড়তদারেরা।
পোস্তার আড়তদার মোখলেস বেপারী বলেন, চামড়া কেনার জন্য আমাদের আড়তে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আড়ত ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। একসময় দেশের সব চামড়া এখানে আসত। তখন এখানে দুই-তিনশ আড়ত ছিল। তখন এই এলাকা ছিল অত্যন্ত ব্যস্ততম এলাকা। কিন্তু এখন ব্যস্ততা কমেছে। বর্তমানে এখানে ৪০ থেকে ৪৫ টি আড়ত রয়েছেন। তারা কেবল ঢাকার চামড়াগুলো কিনে লবণজাত করেন। এরপর এখান থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়।
এ বিষয়ে আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, লালবাগের পোস্তায় এখন ২০ শতাংশ কাঁচা চামড়া আসে। আমরা এই চামড়া ঈদের দুই দিনে কিনে লবণযুক্ত করে ট্যানারিতে পাঠাই।
তিনি বলেন, গত বছর আমাদের পোস্তায় কোরবানির চামড়ার ২০ শতাংশ এসেছে। এবারও আমাদের টার্গেট রয়েছে ২০ শতাংশ চামড়া কেনার। সেই হিসেবে ১ লাখের বেশি পিস চামড়া কেনার টার্গেট আছে। বেশি চামড়া এলে আমরা আরও বেশি কিনব।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে নগদ অর্থ, পর্যাপ্ত লবণ মজুত ও দক্ষ ও অদক্ষ কর্মী-শ্রমিক প্রস্তুত রয়েছে। ট্যানারিগুলো মূলত ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকার কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করবে। মৌসুমি ব্যবসায়ী, মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক যেসব ব্যক্তি চামড়া সংগ্রহ করবেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এবার সবমিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ১৫-২০ লাখ চামড়া সংগ্রহ করার চেষ্টা থাকবে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর ট্যানারি মালিকরা আমাদের টাকা দেয়নি। সরকারের কাছ থেকেও ঋণ পাইনি। আমরা অসহায় অবস্থায় আছি।
তিনি বলেন, এবার ৫০ জন আড়তদার এবং আশপাশের এলাকা থেকে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় করবেন। সবাই মিলে কোরবানির ঈদের প্রথম দুই দিনে ঢাকায় জবাই হওয়া এক লাখ থেকে দেড় লাখ পশুর চামড়া কেনা হবে।
সরকারি দরে চামড়া কেনেন না আড়তদার
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার বর্গফুটপ্রতি দাম গত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা, আর ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ সাত টাকা বাড়ানো হয়েছে।
এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা।\
দাম নির্ধারণে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২০ বর্গফুট হয় বলে হিসাব করে মূল্য ঠিক করা হয়েছে। ঢাকায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া যদি ২০ বর্গফুট হয়, তখন ওই গরুর চামড়ার দাম হবে ১,২০০ টাকা।
আড়তদার বলছেন, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও এই দামে চামড়া কেনেন না তারা। এক লাখ গরুর কাঁচা চামড়া এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ৭০০-৮০০ টাকা বিক্রি হয়।
সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া বিক্রি হয় না, তারপরও দাম বেঁধে দেয় কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আড়তদার মোখলেস উদ্দিন বলেন, সরকার দাম বেঁধে না দিলে চামড়া কেনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
তবে কিছু আড়তদার বলছেন, এক যুগ আগে যে চামড়ার দাম ২০০০ বা ২২০০ টাকা ছিল সেটি এখন ৭০০ টাকা। এর মূল কারণ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে চামড়ার বাজার। ফলে তারা যে দামে ঠিক করে দিচ্ছে এর বাইরে চামড়া কেনার সুযোগ নেই কারও।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার চামড়া দাম ঢাকায় ৫ এবং ঢাকার বাইরে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও লবণ ও মৌসুমি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার কারণে সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা সম্ভব হয়নি। তবে এবার লবণের রেকর্ড উৎপাদন হওয়ায় আশা করছি দাম সহনশীল থাকবে। সেক্ষেত্রে চামড়ার দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
এনএম/এসকেডি