সোনার দাম বাড়া-কমার খেলায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ক্রেতা-বিক্রেতারা
দেশের বাজারে এখন দৈনিক নির্ধারণ করা হচ্ছে সোনার দাম। আজকে বাড়ছে তো কাল কমছে। দাম ওঠানামার এ খেলায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ছেন সোনার অলংকারের ক্রেতাও। যার প্রভাব পড়ছে সোনা বেচা কেনায়। বাড়তি দামের কারণে এমনিতেই সোনার বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম। একদম বাধ্য হওয়া ছাড়া কেউই সোনা কিনছে না। এ অবস্থায় প্রতিদিন দাম বাড়া-কমার খবরে বিভ্রান্তিতে পড়তে হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।
দেশের সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এ খাতের ব্যবসায়ীদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাউস)। সংগঠনটি আগে সপ্তাহ কিংবা মাসে একবার সোনার দাম নির্ধারণ করত। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে সংগঠনটি নিয়মিত সোনার দাম আপডেট করছে। এতে করে অনেকটা বিভ্রান্তিতে আছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা জানান, আগে সোনার দাম জেনে প্রস্তুতি নিয়ে স্বর্ণালংকার কিনতে আসত। এখন প্রতিদিন দাম নির্ধারণ হওয়ায় ক্রেতারা আগে বাজার বুঝার চেষ্টা করছে। অনেকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে দাম কমেছে না কি বেড়েছে। কমার খরব শুনলে আরও কমবে কি না জানতে চাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমিন জুয়েলার্সের জ্যেষ্ঠ এক বিক্রিয়কর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেক দিন স্বর্ণের দাম আপডেট হচ্ছে। এটা আন্তর্জাতিক নিয়ম হলেও এর সঙ্গে আমাদের দেশের ক্রেতা-বিক্রেতারা অভ্যস্ত নন। যে কারণে অনেকে এসে জিজ্ঞেস করছেন দাম কমছে না কি বাড়ছে? কমার খবর শুনে অপেক্ষা করছেন আরও কমে কি না। এ কারণে এখন স্বর্ণের ক্রেতা অনেকটা কম। প্রতিদিন দাম নির্ধারণ হচ্ছে এটা ভালো, যদি আন্তর্জাতিক নিয়মে অনলাইন পদ্ধতি করা যায় তাহলে এটা আরও কার্যকর হবে। তবে দেশের মানুষের কাছে এ বিষয়টি অভ্যস্ত হতে আরও সময় লাগবে।
এ বিক্রিয়কর্মী বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে সোনার দাম কমছে। তারপরও ক্রেতা কম, কারণ একে-তো স্বর্ণের দাম অনেক বেশি, এখনো এক ভরি স্বর্ণালংকার কিনতে গেলে মজুরি ভ্যাট-ট্যাক্স মিলে সোয়া লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে গ্রাহককে। এর সঙ্গে দেশে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না। সব মিলিয়ে কেনা-বেচা নেই বললেই চলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজুসের এক নেতা বলেন, প্রতিদিন দাম নির্ধারণ করলেই যে এই খাতের মানুষের আস্থা আসবে বিষয়টা এমন নয়। তবে আন্তর্জাতিক নিয়মে যেতে পারলে এটা আমাদের জন্য ভালো।
তিনি বলেন, স্বর্ণের দাম কমছে এটা ভালো খবর। তবে ক্রেতার তো সোনার অলংকার বানানোর খরচ কমছে না। এখন এক ভরি সোনার অলংকারে মজুরি ও ভ্যাট মিলিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো দিতে হয়। তার মানে এক ভরি অলংকারের জন্য সোয়া লাখ টাকার উপরে গুনতে হচ্ছে। ক্রেতারা এটা মানতে চান না। আর এতো টাকা ভ্যাট দিয়ে মানুষ কেন স্বর্ণালংকার কিনবে? যাদের অতি জরুরি তারাই কিনছে। চাইলেই এখন গিফট দেয় না। ফলে ক্রেতা কমে গেছে।
বাড়তি ভ্যাটের কারণে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার উল্লেখ করে বাজুসের এ নেতা বলেন, এখন অনেক বিক্রেতা ক্রেতাদের খুশি রাখতে হয় মজুরি কমাচ্ছে অথবা কেউ কেউ তথ্য গোপন করে বাধ্য হয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন আমাদের বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, তা হলো কীভাবে সোনার উপর ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো সেই চেষ্টা করা। সরকারের নীতি নির্ধারকদের বুঝানো যে এ খাতে ভ্যাট-ট্যাক্স কমলে সোনার দাম কমবে ক্রেতাও বাড়বে; তখন কেনাবেচা বেড়ে যাবে; ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি কমবে সরকারও রাজস্ব বেশি পাবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে মার্কেটে সোনার অলংকার কিনতেন আসেন এমদাদুল হক নামে এক ক্রেতা।
তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহে ছোট ভাইয়ের বিয়ে। কিছু স্বর্ণালংকার কিনতে হবে। গত সপ্তাহ থেকে খোঁজ নিচ্ছি দাম ভরিতে ৭ হাজার টাকার মতো কমেছে। বেশ কয়েকদিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজকে কিনতে আসছি। কারণ আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠান।
প্রতিদিন দাম নির্ধারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ ক্রেতা বলেন, এক সপ্তাহ কেনার জন্য অপেক্ষা করলাম কিনব না কি কিনব না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। এখন সময় নেই তাই কিনে ফেললাম। আগে দীর্ঘদিন এক মূল্য থাকত টার্গেট করে নির্ধারিত বাজেটে অলংকার কিনতাম। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো দাম কমেছে। বাড়লে সমস্যায় পড়তাম।
এসব বিষয় জানতে চাইলে বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে আন্তর্জাতিক বাজার দেখে একটি নির্ধারিত সময় দেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ হতো; এখন দেশীয় বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় বাজার বলতে আমরা তাঁতিবাজারের মূল্যকে প্রাধান্য দিয়ে দাম নির্ধারণ করছি। এখন প্রতিদিন নির্ধারণ হচ্ছে; এটি আস্তে আস্তে অনলাইন ফরমেটে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন প্রতিদিন বেশ কয়েকবার মূল্য নির্ধারণ হবে।
আগে যেখানে সপ্তাহে বা মাসে মূল্য নির্ধারণ হতো এখন প্রতিদিন নির্ধারণ হচ্ছে এতে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান জানান, হ্যাঁ এখন নতুন নিয়ম চালু হয়েছে একটু সমস্যা হবে এটা স্বাভাবিক তবে আস্তে আস্তে এ বিষয় অভ্যস্ত হবে ঠিকও হয়ে যাবে। আমরা খোজ খরব রাখছি কোনো সমস্যা হলে ব্যবসায়ীদের এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজুস এখন যে নিয়ম চালু করেছে এটা আসলেই ভালো। আমরা দীর্ঘদিন চেষ্টার পর অবশেষে এটি করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হবে এটা স্বাভাবিক। নতুন জিনিস সবাই বুঝতে পারে না তবে আস্তে আস্তে এটা ঠিক হয়ে যাবে। কারণ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই স্বর্ণের বাজার মুহূর্তে ওঠা-নামা করে আমাদের এখানে পুরনো নিয়মে চলত এখন আস্তে আস্তে এটাকে আপডেট করার চেষ্টা করা হচ্ছে আশা করছি এটা সফল হবে।
এখন ব্যবসা কেমন জানতে চাইলে তিনি জানান, এক সময় স্বর্ণের দাম ছিল কম তখন মানুষের চাহিদাও বেশি ছিল। এখন এক লাখ টাকার উপরে ভরি এটা আসলে আমাদের মতো দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে অনেকে ইচ্ছে করলেও এখন সোনার অলংকার কিনতে পারে না। তাই ক্রেতা তুলনামূলক অনেক কম। তবে এই বাজারটি যদি আধুনিকায়ন হয়, সরকার যদি নীতি সহায়তা দেয় তাহলে অনেকে ক্রেতা আসবে। এখন প্রয়োজন ছাড়া কেউ স্বর্ণালংকার কেনেন না তখন দেখা যাবে অনেকে এ খাতে বিনিয়োগ করবে।
টানা ৭ দফায় কমলো সোনার দাম
এক দিনের ব্যবধানে আজ আবারও সোনার দাম কমানোর ঘোষণা দেয় জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। এ নিয়ে টানা সপ্তমবার স্বর্ণের দাম কমানো হলো।
নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) সোনা ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকা, ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৬ হাজার ২ টাকা, ১৮ ক্যারেটের ৯০ হাজার ৮৬৩ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার দাম ৭৫ হাজার ৫৫৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসআই/এসকেডি