‘বাচ্চু কেলেঙ্কারি’র শাপ মুছবে, শেষ রক্ষা হবে বেসিক ব্যাংকের?
১৯৮৮ সালে নিবন্ধন নেওয়া বেসিক ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে ১৯৮৯ সালে। এক যুগ আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশ ভালো অবস্থানেই ছিল ব্যাংকটি। শিল্প গ্রুপগুলো এই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করত। তখন ব্যাংকটি ভালো মুনাফা অর্জন করত। উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগ দিত। সেই সময় পদাধিকারবলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব।
২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান বানিয়ে বেসিক ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার। এরপরই ব্যাংকটির ছন্দপতন শুরু হয়। নিয়ম ভেঙে এবং তথ্য গোপন করে একের পর ঋণ দেয় বেসিক ব্যাংক। যার অধিকাংশই আদায় করা যায়নি। সংকট দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতা করা হয়। কিন্তু আর্থিক সূচকে উন্নতি করতে পারেনি শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর হাতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে আবদুল হাই বাচ্চুর নানা অনিয়মের তথ্য। পাঁচ বছর (২০০৯-১৪) দায়িত্বে ছিলেন বাচ্চু। এসময় ব্যাংকটিতে ঘটে যায় নজিরবিহীন ঘটনা। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ কেলেঙ্কারির বোঝা এখনো বইছে ব্যাংকটি। ২০১৩-২০২২ সাল- ১০ বছরে লোকসান দিয়েছে ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। কিন্তু বেসিকের অর্থ আত্মসাৎকারীদের এখনো দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি।
আরও পড়ুন
ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে বিকল্প হিসেবে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে বেসিক ব্যাংক নামে এ প্রতিষ্ঠানটি আর থাকবে না।
বেসিক ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যান বেসিক ব্যাংক ছেড়ে যাওয়ার ১০ বছর পার হলেও এখনো ব্যাংকটি আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। কারণ, ওই সময়ে উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে তথ্য গোপন করে কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। যা পরে আদায় করতে পারেনি ব্যাংকটি। কিন্তু আমানতের বিপরীতে ঠিকই সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে আর্থিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনে ব্যাংকটির টাকা লোপাটে শেখ আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতা উঠে এলেও তাকে সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগ করার সুযোগ করে দেয় সরকার। পরের আট বছর আত্মসাৎ করা অর্থে বাড়ি ও জাহাজ কিনে আরাম-আয়েশে জীবন কাটান তিনি। শেষপর্যন্ত তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের বিভিন্ন মামলায় আসামি করে। আবদুল হাইসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে দুদক মোট ৫৯টি অভিযোগপত্র দিয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টিতেই শেখ আবদুল হাই আসামি।
বেসিক ব্যাংকের শীর্ষ ঋণ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো- আমাদের বাড়ি, নিউ ঢাকা সিটি ডেভেলপমেন্ট, এমারেল্ড অটো ব্রিকস, আলী গ্রুপ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, নীলসাগর অ্যাগ্রো অ্যান্ড এলাইড, ফিয়াজ গ্রুপ, অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট গ্রুপ, মিমকো কার্বন লিমিটেড, ভাসাবী ফ্যাশন, ওয়েলটেক্স গ্রুপ, রাইজিং গ্রুপ, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপিং, বাসার গ্রুপ, জেইল ওয়ারস, ম্যাপ অ্যান্ড মুলার গ্রুপ, ওয়েল ওয়েল, রিজেন্ট ওয়েভিং, আইজি নেভিগেশন, বে নেভিগেশন, এমারেল্ড অয়েল অ্যান্ড এলাইড, প্রফিউশন টেক্সটাইল লিমিটেড।
বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ১২ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৬৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি ৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতিও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।
বেসিকের শীর্ষ খেলাপি যারা
বেসিক ব্যাংকের ছাড় করা ১২ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন কেবল ২৫ গ্রাহক। এর মধ্যে ম্যাক্স সোয়েটার, এবি গ্রুপ ও এসপিডিএসপির ঋণ নিয়মিত আছে। বাকি সবাই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ ঋণ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো-- আমাদের বাড়ি, নিউ ঢাকা সিটি ডেভেলপমেন্ট, এমারেল্ড অটো ব্রিকস, আলী গ্রুপ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, নীলসাগর অ্যাগ্রো অ্যান্ড এলাইড, ফিয়াজ গ্রুপ, অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট গ্রুপ, মিমকো কার্বন লিমিটেড, ভাসাবী ফ্যাশন, ওয়েলটেক্স গ্রুপ, রাইজিং গ্রুপ, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপিং, বাসার গ্রুপ, জেইল ওয়ারস, ম্যাপ অ্যান্ড মুলার গ্রুপ, ওয়েল ওয়েল, রিজেন্ট ওয়েভিং, আইজি নেভিগেশন, বে নেভিগেশন, এমারেল্ড অয়েল অ্যান্ড এলাইড, প্রফিউশন টেক্সটাইল লিমিটেড।
বেসিক ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বেসিক ব্যাংক ১৯১৩ সালের কোম্পানী আইনে ১৯৮৮ সালের ২ আগস্ট নিবন্ধিত। ১৯৮৯ সালের ২১ জানুয়ারি এটি কার্যক্রম শুরু করে। দেশের নীতিনির্ধারকরা বেসরকারি পর্যায়ে স্মল স্কেল ইন্ড্রাস্ট্রিজ খাতে অর্থায়নে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
শুরুতে, ব্যাংকটি বিসিসি ফাউন্ডেশনের ৭০ শতাংশ শেয়ার এবং বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) ৩০ শতাংশ শেয়ার নিয়ে একটি যৌথ উদ্যোগে শুরু করে। বিসিসি ফাউন্ডেশন অকার্যকর হওয়ায় এবং বিসিসিআই বন্ধ হওয়ার পর ১৯৯২ সালের ৪ জুন বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকটির শতভাগ মালিকানা গ্রহণ করে। সুতরাং ব্যাংকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার ৩৬ বছর পর এটি এবার একীভূত হচ্ছে অন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
ব্যাংকটিতে এখন চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন প্রফেসর ড. আবুল হাশেম। তিনি আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (একেএমইউ) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের অনারারি প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. আনিসুর রহমান।
আরও পড়ুন
এলো উদ্ধার অভিযান ‘একীভূতকরণ’!
অবশেষে ‘দুর্যোগ’ প্রশমনে বাচ্চু কেলেঙ্কারির শাপে এলামেলো হয়ে যাওয়া বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকটি একীভূত হবে। সোমবার (৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন বৈঠক করেন। সেখানে বেসিক ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নীতিমালা মেনে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করবে ব্যাংক দুটি।
এর আগে গত ১৯ মার্চ সিটি ব্যাংকের পর্ষদকে বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপর সিটি ও বেসিক ব্যাংকের পর্ষদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। দুই ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। ব্যাংক দুটি একীভূত হলেও আগামী তিন বছর পৃথক আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বতঃপ্রণোদিত একত্রীকরণ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নীতি সহায়তা যেহেতু অনেক বেশি, তাই সবল ব্যাংক হিসেবে কোনো দুর্বল ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যায় কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। যেটাই করি না কেন, আগে ওই দুর্বল ব্যাংক পুনর্গঠন করব এবং ৩ বছর বা তার বেশি সময় পরে দুই ব্যালান্সশিট এক করব। এটাই আমাদের ইচ্ছা। পলিসিতে বলা আছে, ব্যাংক পুনর্গঠনে ৩ বছর সময় পাব। ভাল পথে এই তিনটা বছর গেলে আমি আশাবাদী, সময় আরও বাড়বে। দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে আমাদের বিশ্লেষণ চলছে।
বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিটি ব্যাংক ভালো ব্যাংক। এখানে একীভূত হলে বেসিক ব্যাংকের জন্য ভালো হবে। কিন্তু এখানে সিটি ব্যাংকের লাভ কোথায়? তাদের শেয়ার হোল্ডারদের কী হবে? বেসিকের দায় কীভাবে মোচন করবে? একটি লস প্রতিষ্ঠান কেন নিচ্ছে- এ বিষয়গুলো এখনো পরিষ্কার করেনি। ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নেবে দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক ভালো ব্যাংক ছিল। এ ব্যাংকটি যারা ধ্বংস করেছে তাদের মূলে যারা, তাদের কী করবে? একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেন তারা ছাড়া পেয়ে না যায়। সরকারের দায়িত্ব হলো অনিয়মকারীদের ধরা। কেউ যেন অপকর্ম করে পার পেয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা। অর্থ আত্মসাৎকারীদের যদি শাস্তি না দেয় তাহলে এ অনিয়ম ঘটতেই থাকবে।
সিটি ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক অবস্থা
বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক পিএলসি গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ৩৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখা আছে ২৭৯ কোটি টাকা বেশি।
ব্যাংকটি কর-পরবর্তী সমন্বিত নিট মুনাফা করেছে ৬৩৮ কোটি টাকা। যা আগের বছরের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে মুনাফা ছিল ৪৭৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ২০২৩ সালের মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশওপ্রস্তাব করেছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি সিটি ব্যাংক সম্প্রতি তাদের ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। ব্যাংকটি কর-পরবর্তী সমন্বিত নিট মুনাফা করেছে ৬৩৮ কোটি টাকা। যা আগের বছরের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে মুনাফা ছিল ৪৭৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ২০২৩ সালের মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশওপ্রস্তাব করেছে। যা আগামী ৩০ মে তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে।
এই আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে ডলার সংকটের কারণে সিটি ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ থেকে আয় তার আগের বছর থেকে ৭৪ শতাংশ কমে গেলেও ব্যাংকের আমানত ব্যয় কমেছে। একইসঙ্গে ভালো ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং ঋণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার হার ঊর্ধ্বমুখী আছে। এছাড়া সরকারি ট্রেজারি বিল বা বন্ড থেকে মুনাফা কিছুটা বেড়েছে। এসব কারণে ব্যাংকটি গত বছর মোট ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করতে সমর্থ হয়, যা ২০২২ সালে ছিল ১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে সিটি ব্যাংক ঋণের বিপরীতে মোট ২৫৬ কোটি টাকা প্রভিশন সংস্থান বাবদ ব্যয় করেছে।
এসআই/পিএইচ