এতকিছুর পরও কেন নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না এলপিজি?
ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি মাসে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন(বিইআরসি)। কিন্তু নির্ধারিত মূল্যে পণ্যটি বিক্রির দেখা মেলা ভার। স্থানীয় বাজারে এলপিজির প্রতিটি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। আর অসহায় ক্রেতা বেশি দামে নিতেই বাধ্য হচ্ছেন। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাও একাধিক অভিযান চালিয়েও করতে পারছে না কোনো সুরাহা।
ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য গত রোববার ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ৪৭৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিইআরসি। কিন্তু পরদিন আজ সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোম্পানিভেদে ১০০ থেকে ১২০ টাকা অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে প্রতি সিলিন্ডার। এর মধ্যে বসুন্ধরার সিলিন্ডারের দাম ১৬০০ টাকা, ওমেরা সিলিন্ডারের দাম ১৫৫০ টাকা। কেবলমাত্র বিএম কোম্পানির সিলিন্ডার তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে, যার পরিমাণ ১৫২০ থেকে ১৫৩০ টাকা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ডিলার পয়েন্ট থেকে যে দামে সিলিন্ডার কিনতে হয়, তা সরকারি দামের চাইতে বেশি। ফলে তাদের পক্ষে ন্যায্য দামে বিক্রি করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
মোহাম্মদপুরের টাউনহল বাজারের ব্যবসায়ী জসিম উদ্দীন বলেন, কয়েকটা কোম্পানির এলপিজি সিলিন্ডার আমরা বিক্রি করে থাকি। সেসবের দামে কিছুটা পার্থক্য থাকে। কিন্তু সরকারি মূল্যে কেউ বিক্রি করে না। তাই আমাদেরও ন্যায্য দামে সিলিন্ডার বিক্রি করা সম্ভব হয় না।
মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট বাজারের ব্যবসায়ী পারভেজ আহমেদ বলেন, ক্রেতারা আমাদের জিজ্ঞেস করে যে দাম এত বেশি কেন? কিন্তু এখানে আমাদের তো কিছু করার নেই। আমরাও যখন ডিলার বা পাইকারদের জিজ্ঞেস করি যে সরকারি রেটে কেন দিচ্ছেন না, তখন তাদের ভাষ্য— নিলে নেন, না নিলে ভাগেন। এরপর আমাদের আর কিছু বলার থাকে না।
দামের এ তারতম্যে ক্ষুব্ধ ক্রেতারাও। ধানমন্ডির বাসিন্দা কামরুজ্জামান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা সবাই আর্থিক চাপে আছি। এর মধ্যে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরকারি দামে না পাওয়া যায়, এর দায়ভার কে নেবে? আর আমরা টিকে থাকব কীভাবে?
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ইয়াসিন মোল্লা বলেন, বাসাবাড়িতে এলপি গ্যাস ব্যবহার এখন বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রায় সময় লাইনের গ্যাস পাওয়া যায় না। কিন্তু মাসে মাসে বিল দেওয়া লাগছে। আবার সিলিন্ডারের দামও বেড়ে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সেটাও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। দিনশেষে চাপটা কেবলই আমার মতো সাধারণ মানুষের।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে জানা যায়, এলপিজির দামের ভারসাম্যহীনতার অভিযোগ অজানা নয় নিয়ন্ত্রণকারীদেরও। ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনতে তারাও কাজ করে যাচ্ছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক অভিযানও পরিচালনা করছেন তারা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায্যতা নিশ্চিত না করতে পারার দায় বিইআরসিকে নিতে হবে। তারা যদি যথাযথ ব্যবস্থা নিত তাহলে দামের এই তারতম্য নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
আরও পড়ুন
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতির (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, ভোক্তাপর্যায়ে ন্যায্য দামে এলপিজি বিক্রি না করা হলো বিইআরসির আদেশকে উপেক্ষা করা। যা দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বিইআরসি যথাযথ পদক্ষেপও গ্রহণ করছে না। বরাবর তারা দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা যদি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে বাজারে এলপিজির দামে ন্যায্যতা বজায় থাকত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব স্ট্র্যাটেজি জাকারিয়া জালাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলপি গ্যাস একটি আমদানি করা পণ্য। প্রতি মাসে এলসি খুলে তা আমদানি করতে হয়। বর্তমান ডলার সংকটে এলসি খোলার ধারবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটছে। এতে করে একটা গ্যাপ তৈরি হয়। আর সেই গ্যাপের সুযোগ নিয়ে থাকে ডিলার বা মধ্যস্বত্বভোগীরা। এছাড়া আমাদের গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রেও কিছু ইস্যু আছে, সে বিষয়ে আমরা বিইআরসির সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করছি শিগগির এর সমাধান হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলপিজি সিলিন্ডারের এক পরিবেশক বলেন, গ্যাস কোম্পানি থেকে ১২ কেজি গ্যাসের একটি সিলিন্ডার কেনার পর এর সঙ্গে যোগ হয় গাড়িভাড়া ও লেবার খরচ। তাই বাধ্য হয়ে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বেশি দামে সিলিন্ডার বিক্রি করতে হয়। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে গেলে কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে ভাগতে হবে।
এ প্রসঙ্গে এলপি গ্যাস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মো. হামিদ লতিফ ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিইআরসি যে দামটা নির্ধারণ করে, সেটা শুধু পণ্যের দাম। এর বাইরে কিন্তু আমাদের বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খরচ থাকে। ফলে সরকারি মূল্যে বিক্রি করাটা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
জানতে চাইলে বিইআরসির সচিব (প্রশাসন ও আইন) ব্যারিস্টার মোহাম্মদ খলিলুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ভোক্তারা যদি আমাদের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন, তবে আমরা সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেব।
ব্যবস্থা কি ব্যবসায়ী না কোম্পানির বিরুদ্ধে নেওয়া হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দোকানি যদি কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ডকুমেন্ট দেখাতে পারে যে অতিরিক্ত মূল্য নিচ্ছে, তাহলে আমরা সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
ওএফএ/এমজে