নির্বাচনের আগে ঋণ নিয়মিত করার হিড়িক, কমলো খেলাপি ঋণ
# খেলাপি ঋণ এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা
# মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ খেলাপি
# তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা
# এক বছরে বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা
# ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা
# ২০২১ সালে এক লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা
# ২০২২ সালে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা
# ২০২৩ সালের জুনে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা
আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ঋণ খেলাপি থাকলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। তাই নির্বাচনে অংশ নিতে খেলাপি থেকে বাঁচতে ঋণ পরিশোধ করেছেন অনেকে। আবার প্রভাব খাটিয়ে নানা সুযোগ সুবিধা নিয়ে ঋণ নিয়মিত করছে কোনো কোনো গোষ্ঠী। ফলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সামান্য কমেছে। তবে বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সেপ্টেম্বর-২০২৩ প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) এ প্রতিবেদন অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
আরও পড়ুন
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন-সেপ্টেম্বর সময়ে অর্থাৎ তিন মাসে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে (মার্চ ২৩ থেকে সেপ্টেম্বর) বেড়েছে ২৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। নয় মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) বেড়েছে ৩৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। আর এক বছরে (সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা।
গত জুনে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা ও মার্চে ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষে ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা; যা ওই সময়ের মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটা খেলাপি ঋণের আসল চিত্র নয় বলে জানিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দেয় আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের) তা গ্রহণ করে না। তার মানে এ হিসাবের চেয়ে খেলাপি ঋণের মাত্রা অনেক বেশি। এখানে পুনঃতফসিল করা ঋণের হিসাব নেই। আদালতে অনেক খেলাপি ঋণ স্থগিত করা আছে তার হিসাবও আসে না। এগুলো যোগ করলে খেলাপি ঋণের অঙ্ক অনেক বেশি হবে।
শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমার বিষয় এই অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, আইন অনুযায়ী খেলাপিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে না। এজন্য অনেকে নির্বাচন করার জন্য ঋণ নিয়মিত করেছে। যার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে খেলাপি ঋণ সামান্য কমেছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি হিসাব করলে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের চিত্র সুখকর নয় বলেও জানান তিনি।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। গ্রাহককে ঋণ শোধ না করেও ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কম সুদে ঋণ নেওয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। চলতি বছরও ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রয়েছে বিশেষ ছাড়। তবে এ সুযোগ ছিল গত জুন পর্যন্ত। এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যার কারণে নানা উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আইএমএফের শর্ত
ডলার সংকটে পড়ে আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য দারস্থ হয় বাংলাদেশ। নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে আইএমএফ। গত ফেব্রুয়ারিতে এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার পায় বাংলাদেশ। দেশে ডলার সংকট চলাকালে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা।
আরও পড়ুন
এ ঋণের অন্যতম শর্ত হলো ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা। ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। তবে সব শেষ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হার দাড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ যা নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ তিন হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে।
বেসরকারি ব্যাংকে আলোচিত সময়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ।
বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ৬৪ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ খেলাপি এবং বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর ৩৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ বা ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
এমএসআই/কেএ