ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছেই
ঊর্ধ্বমুখী ধারায় আছে ঋণের সুদহার। চলতি বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের পর নভেম্বর মাসেও বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদহার।
ঋণের সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নতুন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। ওই পদ্ধতি অনুযায়ী ৬ মাসের অ্যাভারেজ করে একটা সুদহার নির্ধারণ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সুদহারকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে ‘সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’, সংক্ষেপে এসএমএআরটি বা স্মার্ট। প্রতি মাসের শুরুতে এই সুদহার বা ‘স্মার্ট’ জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চলতি বছরের জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদহার (স্মার্ট) ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। সবশেষ অক্টোবরে স্মার্ট বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, অক্টোবর মাসের ‘স্মার্ট’-এর সঙ্গে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে নভেম্বর মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ করতে পারবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অবশ্য একবার সুদহার কার্যকর করা হলে পরবর্তী ছয় মাসে তা আর পরিবর্তন করা যায় না।
ব্যাংকের সুদহার
অক্টোবর মাসের ‘স্মার্ট’-এর সঙ্গে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে নভেম্বর মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। সেই হিসেবে, চলতি নভেম্বরে মাসে ব্যাংক বড় অংকের ঋণে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণের সুদহার হবে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর কৃষি ও পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ সুদ নিতে পারবে।
তবে ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে ব্যাংক নিতে পারবে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ সুদ। কারণ সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার
ব্যাংকের ক্ষেত্রে শুধু ঋণের সর্বোচ্চ সীমা থাকলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত সংগ্রহেও সুদহারের একটা সর্বোচ্চ সীমা দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সুদ যোগ করে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ করে ঋণের বিপরীতে সুদ নিতে পারবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এনবিএফআই। সেই হিসেবে নভেম্বর মাসে তাদের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং আমানতে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তবে নভেম্বরে ঠিক করা ঋণের এই সুদহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদহার প্রকাশ করছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, গত জানুয়ারিতে স্মার্ট ছিল ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এরপর প্রতি মাসে একটু করে বেড়ে গত মে মাসে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। জুন ও জুলাইয়ে সামান্য কমে ৭ দশমিক ১০ শতাংশে নামে। এরপর আগস্ট থেকে ধারাবাহিক সুদহার বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর পরামর্শে ৯০ দশকের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা আরোপ করা হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন পর্যায় থেকে সীমা তুলে নেওয়ার জন্য বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও সুদহারের সীমা প্রত্যাহার অথবা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সরকারের ইতিবাচক সায় না পাওয়ায় নীরব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত সুদহার বাজারভিত্তিক করা। সেই শর্তের আলোকে নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হবে।
ভুল নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমাদের কিছু ভুল নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এর মধ্যে অন্যতম আমাদের সুদহার ৯ শতাংশকে এক জায়গায় দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে, তবে এটাও একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাজার ভিত্তিক করা জরুরি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট মাসে তা আবার বেড়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। যা বিগত বছরগুলোতে কখনো হয়নি। এর আগের মাসে এই খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২.৭৮ শতাংশ।
এসআই/এসকেডি