পুঁজিবাজারে মালিকানাবিহীন ২১ হাজার কোটি টাকা
পুঁজিবাজারে টাকা লোপাট হওয়ার ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। বিষয়টি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে। এবার ভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে দেশের পুঁজিবাজার। ১৯৭৬ সালের পর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা অর্থের বিপরীতে নগদ ও বোনাস লভ্যাংশ সংগ্রহ করেননি অসংখ্য বিনিয়োগকারী।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে টাকার পরিমাণ। যা বর্তমানে ২১ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত মালিকদের কাছে এ টাকা পৌঁছে দিতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসির তথ্য মতে, কোম্পানির লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় শেয়ার কিনেছিলেন বিনিয়োগকারীরা। ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করা হলেও তা পৌঁছায়নি বিনিয়োগকারীদের কাছে। গত ৪৪ বছরে এ রকম নগদ ও বোনাস শেয়ার লভ্যাংশের টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার কোটি। এর মধ্যে ৩-৪ হাজার কোটি টাকার বোনাস শেয়ার আর বাকি ১৭ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে নগদ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুই শতাধিক কোম্পানির কাছে দীর্ঘদিন ধরে অলস পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ টাকা। এর মধ্যে বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের কাছে (বিএটিবিসি) নগদ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি রয়েছে। এছাড়া ১০ হাজার কোটি টাকা (নগদ ও বোনাস মিলে) পড়ে আছে রেকিট বেনকিনজার, লিন্ডে বিডি এবং বার্জার পেইন্টসসহ দেশি-বিদেশি অন্য কোম্পানিগুলোর কাছে। সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরে আসে বিষয়টি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন বিনিয়োগকারীদের এই টাকা কোম্পানির কাছ থেকে সংগ্রহ শুরু করেছে।
গঠন হবে নতুন ফান্ড
সূত্রটি জানায়, টাকার মালিকদের খুঁজে বের করার পাশাপাশি ‘ক্যাপিটাল মার্কেট ‘এস্টাব্লিশমেন্ট ফান্ড অব বিএসইসি’ নামে একটি ফান্ড গঠন করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সে লক্ষ্যে শিগগিরই একটি নীতিমালা তৈরি করে ফান্ডের কার্যক্রম শুরু হবে। এ কর্যক্রমের শুরুতেই টাকার মালিকের খোঁজে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। এছাড়াও তাদের দেওয়া ঠিকানায় চিঠি পাঠানো হবে। মালিকরা সঠিক প্রমাণ সাপেক্ষে টাকার দাবি করলে ১৫ দিনের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
প্রয়োজন অনুযায়ী এ টাকা ব্যবহার করবে বিএসইসি
যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মালিকদের খুঁজে না পাওয়া যাবে ততক্ষণ এই অর্থ এস্টাব্লিশমেন্ট ফান্ডে থাকবে। ফান্ডটি বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও বাজার স্থিতিশীল করতে কাজ করবে। প্রয়োজনে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম খুব কমে গেলে, শেয়ার কিনে তা স্থিতিশীল করা হবে। আবার কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি বাড়লে সেখানে শেয়ার সরবরাহ করে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। এছাড়াও এ তহবিল নিয়ে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংককে ঋণ দেবে বিএসইসি।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের ২০-২১ হাজার কোটি টাকা দীর্ঘদিন ধরে মালিকানাবিহীন পড়ে আছে। এই টাকার প্রকৃত মালিকদের খোঁজা হচ্ছে। তাদের পাওয়া গেলে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। যদি না পাওয়া যায় তবে এই টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হবে। এ লক্ষ্যেই কাজ এগিয়ে চলছে।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে অনেক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন, তারা লভ্যাংশের টাকা পাচ্ছেন না। বিনিয়োগকারীদের টাকার খোঁজ করতে গিয়ে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। আমরা দেখলাম, কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের চেক বা দলিল এখনো পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ঠিকানায় পাঠায়। পোস্ট অফিসগুলো অবহেলা করছে, ঠিকমতো লভ্যাংশের চিঠি বিনিয়োগকারীদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। এখন আধুনিক প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে সব লভ্যাংশ পরিশোধ করতে বলেছি। কিন্তু তারপরও অভিযোগ আসছে। তাই নতুন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমরা বিনিয়োগকারীদের এই টাকা দিয়ে আলাদা ফান্ড গঠন করব। কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওই ফান্ডে রাখা হবে। টাকার মালিকরা সঠিক প্রমাণসহ আবেদন করলে তা দ্রুতই পরিশোধ করে দেওয়া হবে।
উদ্যোগ ভালো তবে...
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহেমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মালিকদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগটি ভালো। তবে আলাদা ফান্ড গঠন করা কিংবা এ ফান্ড পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করাই ভালো। কারণ এই টাকার মালিক সাধারণ জনগণ। বিনিয়োগ করলে যদি লোকসান হয়ে তবে এর দায় কে নেবে?
প্রায় একই মত দেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূলত ডিমেট শেয়ার অর্থাৎ কাগুজে শেয়ারের মালিকদের টাকাই জমা পড়ে আছে। যেহেতু অনেক দিন আগের টাকা তাই মালিকদের খোঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
এমআই/এসকেডি