অর্থ পাচারকারীদের তথ্য কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই?
# ঋণের এক-চর্তুথাংশ “খেলাপি”
# হুন্ডিতে প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে
# অর্থ পাচার বন্ধ না হলে বাড়বে না রেমিট্যান্স
# রেমিট্যান্সে প্রণোদনায় দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে না
বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। হুন্ডিতে চলছে রমরমা বাণিজ্য। এতে করে বৈধ পথে রেমিট্যান্স কমে গেছে। ভয়াবহ ডলার সংকটে পড়েছে দেশ। যারা অর্থ পাচার করছে বা হুন্ডির সঙ্গে জড়িত তাদের তথ্য কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই? তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, এমন প্রশ্ন তুলেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে সোমবার (২৩ অক্টোবর) বৈঠক করেছে সানেম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চার ডেপুটি গভর্নর, অর্থসচিব খাইরুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান এবং বেসরকারি গবেষণা-প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ও অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা।
বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সানেমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- দেশের অর্থনীতি এখন একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এখন যদি সঠিক পদক্ষেপ বা নীতি গ্রহণ করা না হয় তাহলে আগামীতে এই সংকট আরো ঘনীভূত হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একমত হয়েছে।
আলোচনার মূল বিষয় ছিল বর্তমান সমস্যা ও এটি সমাধানে করণীয় কী? এসময় মূল্যস্ফীতি, বাজার বিত্তিক ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট, সুদহার, অর্থপাচার ও খেলাপি ঋণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে—জানান ড. সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থ পাচার বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স বাড়বে না। যারা অর্থ পাচার করছে তাদের তথ্য কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই?
এসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হলো-কারা পাচার করছে তাদের আইডেন্টিফাই করা যায়। তবে তথ্য প্রমাণ না থাকায় আইনের আওতায় আনা যায় না। এ বিষয়ে আমরা (সানেম) দ্বিমত প্রকাশ করেছি---কারণ যদি পাচারকারীদের আইডেন্টিফাই করা যায় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের যে বিশেষ সংস্থা আছে তারা যদি ইচ্ছে করে পাচারকারীদের তথ্য প্রমাণ বের করা কঠিন হওয়ার কথা না। ---এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জোর দিয়েছি। কারণ অর্থ পাচার বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স বাড়বে না।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। সাত বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। তবে পাচারের এই অংক এখন অনেক বড় হয়ে গেছে বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
এক্সচেঞ্জ রেট প্রসঙ্গে ড. সেলিম রায়হান বলেন, এখন অর্থনীতিতে অন্যতম সমস্যা এক্সচেঞ্জ রেট, এটাকে অবশ্যই বাজারভিত্তিক করতে হবে। এটা নিয়ন্ত্রণ করে রেমিট্যান্স আনা সম্ভব না।
রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দীর্ঘ মেয়াদি সুফল আসবে না জানিয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. রায়হান বলেন, সরকারের আড়াই শতাংশের সংঙ্গে আরো বাড়তি আড়াই শতাংশ ডলার রেট বেশি দেবে সবমিলিয়ে রেমিট্যান্সে ৫ শতাংশ প্রণোদনা পাবে- এ ধরনের পদক্ষেপ সাময়িক সময়ের জন্য রেমিট্যান্স বাড়াবে তবে দীর্ঘমেয়াদি কোন সমাধান হবে না। রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে হন্ডি বন্ধ করতে হবে। আ হুন্ডি বন্ধ করতে হলে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। এখন প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে এটা যে কোনো উপায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি জানা, ব্যাংকগুলো যত বেশি প্রণোদনা দেবে হুন্ডির লোকজন তার চেয়ে বেশি প্রণোদনা দেবে। তাই হুন্ডি যত পর্যন্ত রমরমা থাকবে তত পর্যন্ত বৈধ পথে আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসবে না।
ভুলনীতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে জানিয়ে ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমাদের কিছু ভুলনীতির কারণে মূল্যস্ফীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এর মধ্যে অন্যতম আমাদের সুদহার ৯ শতাংশ একটি জায়গায় দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে তবে এটাও একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ উদ্যোগের তাগিদ দিয়ে ড. সেলিম বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যায় আমদানি খরচ বেড়েছে এখন পণ্যের দাম বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এখানে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআর এর ভূমিকা লাগবে। মুদ্রানীতির সঙ্গে সরকারের নীতি ও রাজস্ব নীতি ও সমন্বয় করে পণ্যের দাম কমাতে হবে। কর ছাড়ের মাধ্যমে ভোগ্যপণ্যের আমদানিক ব্যয় যদি না কমানো যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
ঋণের এক-চর্তুথাংশ “খেলাপি”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের মতে এখন যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি খেলাপি ঋণ।
এ বিষয়ে ড. সেলিম রায়হান বলেন, বর্তমানে খেলাপি ঋণের যে অংক দেখানো হচ্ছে এটা আসলে সঠিক নয়, বাস্তবে আরো অনেক বেশি; খেলাপি মোট ঋণের এক-চর্তুথাংশ হবে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে একমাত্র পোষণ করেছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমানো বিষয় আমরা বলেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে তারা এখন নতুন করে কোন উদ্যোগ নেবেন না, নির্বাচনের পরে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে। এ বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক কোনো প্রতিশ্রুতি কেন্দ্রীয় পেয়েছে কি না জানতে চেয়েছিলাম তারা বলেছে-সহযোগীতা পাবো এটা আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবে বাস্তবে খেলাপি ঋণের এই অংক হবে পৌনে চার লাখ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি চাপে দেশ। সঙ্গে চলছে তীব্র ডলার সংকট। বাজেট ঘাটতি অর্থনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই সমাধান খুঁজতে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞসহ খাত সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ নিচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে সহায়ক হতে পারে বিবেচনায় অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সবার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
প্রথমে ২১ সেপ্টেম্বর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে একই বিষয়ে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেদিন নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। কেননা এ ধরনের প্রবণতা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে।
গণমাধ্যমকে তিনি আরও জানান, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে বাজারে লাগাম টানার আগে ‘মূল্য প্রত্যাশা’র লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছি। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেছি।’ এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও তাতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ। ‘পণ্যের দাম বাড়বে—এমন প্রত্যাশা যখন স্থায়ী হয়, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বেঁধে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং মূল্য প্রত্যাশা কমাতে সমন্বিত ও বিশ্বাসযোগ্য নীতি গ্রহণ এবং তার মাধ্যমে বাজারে সংকেত দিতে হয়। এ ছাড়া দৃশ্যত যেখানে একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে ওঠে, সেখানে তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর কথা বলেছি।’
এরপর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এবং সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান এর সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দেন আহসান এইচ মনসুর। তার মতে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলে এমনিতেই ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।
সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান চলমান অর্থনীতির সংকট সমাধানে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে বড়দের ঋণ কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার জরুরি বলে জানান। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমাতে ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি’ গ্রহণ এবং খরচ কমানো দরকার। এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতা বড় বিষয়---বলে জানান সাবেক এই গভর্নর।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট মাসে তা আবার বেড়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। যা বিগত বছরে কখনও হয়নি। এর আগের মাসে এই খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২.৭৮ শতাংশ।
এসআই/