লুনা শামসুদ্দোহা : একজন অনুকরণীয় তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যক্তিত্ব লুনা সামসুদ্দোহা নারী উদ্যোক্তাদের কাছে অনুকরণীয় এক নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। অবদান রেখেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ, প্রযুক্তিখাতে দক্ষ কর্মী তৈরি, উদ্যোক্তা বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে।
বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি (বিডব্লিউআইটি) সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ছিলেন এই সংগঠনের সভাপতি। দোহা টেক নিউ মিডিয়া নামের সফটওয়্যার ফার্মের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু করেন প্রযুক্তিখাতে ব্যবসা। অনেকটা বিপরীত স্রোতে গা ভাসানোর মতো। সেই চ্যালেঞ্জ সাদরে গ্রহণ করে অর্জন করেছিলেন গর্ব করার মতো সাফল্য। সফল উদ্যোক্তার স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের প্রথম নারী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন লুনা শামসুদ্দোহা।
আজ এই মহীয়সী নারীর ৬৯তম জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের ৪ অক্টোবর তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। লুনা কেবল ব্যবসায়িক সাফল্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ, সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিরলস কাজ করে গেছেন সারাজীবন। সরকারের ই-জিপি সিস্টেমসহ প্রযুক্তিখাতের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান উল্লেখ করার মতো।
লুনা সবসময় বিশ্বাস করতেন আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন সম্ভব। অর্থনীতির বিকাশও আরও সহজ হবে। ২০১৬ সালে ভারতের কলকাতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায় আয়োজন করা ‘ইন্দো-এশিয়া কানেকটিভিটি ফর শেয়ারড প্রসপারিটি’ সম্মেলনে তিনি এ নিয়ে চমৎকার নিবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি তার উপস্থাপনায় এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন।
লুনা সামসুদ্দোহার মধ্যে দক্ষ আইটি কর্মী তৈরি কিংবা পেশাজীবীদের দক্ষতার উন্নয়নে কাজ করার তীব্র তাগিদ ছিল সবসময়। তাইতো, দেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে এগিয়ে আসেন। অর্থনীতির মতো জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করতে হলে সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নিজস্ব অফিস স্থাপন ও ইআরএফ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠায় নি:স্বার্থভাবে কাজ করেছেন। তার এই অবদান আজও সাংবাদিকরা হৃদয় থেকে স্মরণ করে।
লুনা সামসুদ্দোহা একাধারে দোহাটেক নিউ মিডিয়ার চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডব্লিআইটি) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, আইসিটি শিল্পদক্ষতা পরিষদের পরিচালক, বেসিস পরিচালক এবং রাষ্ট্রায়াত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব পাওয়া তিনিই প্রথম নারী যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়াত্ত কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পূর্বে ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে জনতা ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়াত্ত আরেক ব্যাংক-অগ্রণী ব্যাংকেরও পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া, তিনি বাংলাদেশ বিজনেস ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সুইজারল্যান্ডের গ্লোবাল থট লিডার অন ইনক্লুসিভ গ্রোথের সদস্য ছিলেন।
২০১৩ সালে প্রযুক্তি খাতে নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও নারীর ক্ষমতায়নে গ্লোবাল উইমেন ইনভেন্টরস অ্যান্ড ইনোভেটরস নেটওয়ার্ক সম্মাননা লাভ করেন লুনা। দেশের অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড-২০১৭। এছাড়া একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে স্থানীয় সফটওয়্যার শিল্পে নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে লুনা শামসুদ্দোহা অনন্যা টপ টেন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
১৯৫৪ সালের ৪ অক্টোবর লুনা সামসুদ্দোহার জন্ম ঢাকায়। তার বাবার নাম লুৎফার রহমান এবং মায়ের নাম হাসিনা রহমান। তিনি ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
১৯৮৫ সালে দ্য এক্সিকিউটিভ সেন্টারের ব্যবস্থাপনা সহযোগী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন লুনা সামসুদ্দোহা। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন।
তার প্রতিষ্ঠান দোহাটেক নিউ মিডিয়া সফটওয়্যার ও সিস্টেম ডেভলপমেন্টের কাজ করে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ভুটান, মালদ্বীপ, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বেসরকারি সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনের জন্য সফটওয়্যার সলিউশন দিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সার্ভিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া, দোহাটেক নিউ মিডিয়া ডিজিটাল সার্টিফিকেট প্রদান করার জন্য নির্বাচিত একটি প্রতিষ্ঠান।
লুনা সামসুদ্দোহার স্বামী ব্যবসায়ী এ কে এম সামসুদ্দোহা। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান রিম সামসুদ্দোহা। প্রযুক্তিখাতের অগ্রণী এই উদ্যোক্তা ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অসংখ্য মানুষকে অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে মায়াময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আজ তার ৬৯তম জন্মদিনে উদারচেতা স্বপ্নবান মানুষটির আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তিনি তার কর্মগুণে মানুষের মাঝে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন। গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি ও ধন্যবাদ জানাই বেসিসকে। সংগঠনটি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশেষ অবদানের কথা স্মরণে রেখে গত বছর থেকে ‘বেসিস লুনা শামসুদ্দোহা অ্যাওয়ার্ড’ চালু করেছে।
পরিশেষে বলতে চাই- ‘নাম মানুষকে বড় করে না, কর্ম মানুষকে বড় করে তোলে’। এই মহান উক্তিটি প্রয়াত লুনা সামসুদ্দোহার ক্ষেত্রে সার্থকতা পেয়েছে। প্রিয় এই মানুষের জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
লেখক : এস এম রাশিদুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)।