সাত ধরনের সমস্যায় দেশে বৈষম্য ও দারিদ্র্য বেড়েছে
সাত ধরনের সমস্যার কারণে দেশে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- শোভন কর্মপরিবেশের অভাব, নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি, অবকাঠামোতে আঞ্চলিক বৈষম্য, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা না পাওয়া, জলবায়ু সমস্যা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, দুর্নীতি ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অভাব।
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের কনভেনশন হলে ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা : পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাবনা’ শীর্ষক বইয়ের জনপ্রকাশ অনুষ্ঠান ও সংলাপে এ তথ্য উঠে আসে।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এক গবেষণায় এমন তথ্য উপস্থাপন করে সংস্থাটির আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়ন হলেও তার সুফল দেশের মানুষ পায়নি। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা না থাকলে সরকার তার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে পারে না।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়ন হলেও সবাই এর ভাগীদার হতে পারেনি। কোনো দেশে বৈষম্য যদি বহুদিন ধরে চলে তখন সেই সব দেশে শুধু উন্নয়নই না, সামাজিক কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়। সেখানে যেসব দ্বন্দ্ব সংগ্রামের সৃষ্টি হয় তা মোকাবিলা করার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি সেই দেশের থাকে না।
এই সাত সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, শোভন কর্মসংস্থান না থাকায় শিক্ষিত বেকার বেড়েছে। এর ফলে অনেকেই কম মজুরিতে কাজ করছেন।
অবকাঠামো উন্নয়নেও বৈষম্য রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখানে এলাকাভিত্তিক বৈষম্য রয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন একপেশে হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না। ছোট দেশে আমাদের আঞ্চলিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এছাড়া এই সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা কোনো অংশে কমেনি, বরং বেড়েছে। এখন বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় কোনো আঞ্চলিক সমস্যা না, এটা একটা জাতীয় সমস্যা। বাংলাদেশে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে পরিবেশ প্রতিকূল অবস্থায় নেই।
তিনি আরও বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা খুবই দুর্বল। দেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বড় ধরনের অবক্ষয় হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, গান-বাজনা, নৃত্য এসব ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি ছিল সেটা বহুখানি অবনমন হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্বল হয়ে গেছে। দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তার করেছে।
উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বৈষম্য বাড়ছে জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে যে সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ ধনী আছে তারা ৪১ শতাংশ আয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সবচেয়ে গরিব যে ১০ শতাংশ মানুষ আছে তারা ১ দশমিক ৩ শতাংশ আয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্যবধান কিন্তু বছর বছর বাড়ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি গ্রামীণ দারিদ্র্য ও বেড়েছে।
বৈষম্য বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অলিগার্কের উদ্ভব হয়েছে। অলিগার্ক তারাই যারা অত্যন্ত বিত্তবান, একইসঙ্গে তারা বৃহৎভাবে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। এই গোষ্ঠীর উদ্ভব এখন যেভাবে দেখছি, বিগত বছরে সেটা চোখে পড়েনি। এই বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি কেবলমাত্র আয়ের ক্ষেত্রে বা সম্পদের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়নি। এটা ক্রমান্বয়ে আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে বিস্তার লাভ করেছে।
এই সমস্যা সমাধানে গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারসহ মোট ১১টি সুপারিশ করে তিনি বলেন, নাগরিক সমাজের কাজের জায়গা আগের চেয়ে অনেক বেশি সংকুচিত হয়ে গেছে। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। একটা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা যদি না থাকলে সরকার তার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে পারে না। সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি নিশ্চিত করতে হলে গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার জরুরি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রমুখ।
নাসিম মঞ্জুর বলেন, ভারতের অর্থনীতি আমাদের চেয়ে বড়জোর ১০ গুণ বেশি। কিন্তু সেখানের চাকরির ওয়েবসাইট নকরি ডটকমে যতগুলো কর্ম অ্যাভেইলেবল তা আমাদের বিডিজবসের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি। কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার ডিরেক্ট সম্পর্ক আছে। সেখানে যদি পরিবর্তন না করতে পারি, আমরা কর্মসংস্থান করতে পারব না। আমরা এডুকেশনটাকে বেশি ভোগ করছি বাংলাদেশে। আমাদের ৭০ শতাংশ টারশিয়ারি এডুকেশন আসে পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে। সবার আশা আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেছে। সবার ছেলে-মেয়ে ইউনিভার্সিটি পড়ছে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সব জায়গায় কী বিএসসি, বিবিএ, দরকার? দরকার নয়। এটা আমি ২২ বছর ধরে বলে আসছি। আমাদের কারিগরি শিক্ষা দরকার। কিন্তু এখানে সামাজিক সমস্যা আছে।
তিনি বলেন, ছেলে যদি ওয়েল্ডার হয় তার বিয়ে হবে না। মেয়ে যদি মাস্টার্স পাস না হয় তার বিয়ে করা সম্ভব না। অনেক রকম সামাজিক স্টিগমার কাজ করছে। এখানে ওভার কনজাম্পশন অব এডুকেশন এটা বিরাট সমস্যা। বলা হচ্ছে, ক্লাসে শিক্ষার্থী নাই, পরীক্ষার্থী আছে। পুরোনো ফোকাসটা হচ্ছে পাস করা। কিন্তু দক্ষতা নিয়ে কাজ করছি না। শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতাও আমাদের রাইট হওয়া উচিত। শিল্পখাতে আমাদের কর্মসংস্থান কমছে। সেবাখাতে চাকরি বাড়ছে প্রবৃদ্ধি কমছে।
রেহমান সোবহান বলেন, গত ১৫-১৬ বছরে অনেক ভালো কাজ হয়েছে। আমার এক সময় ফরেন একচেঞ্জ রিজার্ভ অলমোস্ট ৫০ বিলিয়ন ডলার, এখন আনফরচুনেটলি প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারে চলে আসছে। তার মানে এই নয় যে এটা আবার ৫০ বিলিয়নে যেতে পারব না। শুধু গ্রোথ হয়নি, অনেক উন্নতি হয়েছে। পদ্মা ব্রিজ হয়েছে। এটা অনেক বড় কাজ। এজন্য প্রধানমন্ত্রী ও তার টিমকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি আরও বলেন, অবকাঠামোর উন্নয়ন দরকার আছে, করতে হবে। তা না হলে গ্রোথ হবে না, কর্মসংস্থান হবে না। উন্নয়নে আমরা প্রচুর অর্থ খরচ করছি। কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধান করতে পারছি না। আমরা উন্নয়নে ফোকাস করছি বেশি। এছাড়া বাস্তবায়নের সমস্যা আছে, কারণ দুর্নীতি ও সুশাসনের সমস্যা আছে।
আরএম/জেডএস