কত টাকা নিয়ে গেছে এমটিএফই?
বর্তমানে দেশের আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম এমটিএফই প্রতারণা। গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্রই এর প্রতারণার জাল ছড়িয়ে পড়েছিল। স্কুলছাত্র থেকে বৃদ্ধ, কুলি-কৃষক থেকে ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, কেউই এ প্রতারণার ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি। দেশের প্রায় সব এলাকায় এমটিএফই প্রতারণার শিকার মানুষ পাওয়া যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতারণার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে এমএলএম কোম্পানিটি।
এমটিএফই’র প্রতারণার রহস্য উদ্ঘাটন এবং মূল অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। কিন্তু এত আলোচনা ও তৎপরতার মধ্যেও এমটিএফই দেশ থেকে কত টাকা বিদেশে পাচার করছে তা ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে।
বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, এমটিএফই’র গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৪১ লাখ। আবার কোনো কোনো মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, গ্রাহক সংখ্যা ছিল আট লাখ। লাখ লাখ গ্রাহক থেকে অর্থ হাতিয়ে এমটিএফই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসলে কত টাকা এমটিএফই দেশ থেকে পাচার করেছে- এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, এখন পর্যন্ত চলা তদন্তে এটা প্রায় নিশ্চিত এমটিএফই দেশ থেকে টাকা পাচার করে থাকলে, সেটি মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করেছে। পাচার হওয়ার টাকার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
এমএটিএফই দেশ থেকে কত টাকা পাচার করেছে তা একমাত্র বলতে পারবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও জানা সম্ভব না
আরও পড়ুন : ডেসটিনির মতো শুয়ে-বসে আয়ের লোভ দেখিয়ে উধাও এমটিএফই
এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমএটিএফই দেশ থেকে কত টাকা পাচার করেছে তা একমাত্র বলতে পারবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও জানা সম্ভব না। টাকা যদি পাচার হয়ে থাকে তাহলে বিএফআইইউতে অ্যালার্ট যাওয়ার কথা। তাই বিএফআইইউ ছাড়া এ বিষয়ে সঠিক তথ্য কারও কাছে থাকার কথা নয়।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন এক হাজার কোটি টাকা পাঠানো সম্ভব। মাত্র ১০ দিনে হাজার কোটি টাকা পাঠানো সম্ভব। তবে, টাকা পাঠানো হলে আমাদের মানি লন্ডারিং সফটওয়্যারে ফ্ল্যাগ করার কথা। আসলে এ ধরনের সফটওয়্যার বিএফআইইউতে আছে কি না, কিংবা সচল আছে কি না, তা দেখতে হবে।
দুর্ঘটনা যখন ঘটে তখন আমাদের টনক নড়ে- উল্লেখ করে এ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের কোনো উদ্যোগ থাকে না। ইভ্যালির প্রতারণার সময় শোনা গিয়েছিল যে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে। তখন যদি সব কিছু ঠিক করা হতো আজ এমটিএফই নিয়ে এসব প্রশ্ন উঠত না। আমাদের সব লেনদেন কিন্তু সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়। এমনকি এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গেও জড়িত। সেটি তফসিলভুক্ত ব্যাংক হোক আর মোবাইল ব্যাংকিংই হোক না কেন। যে কোনো লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে গিয়ে করা সম্ভব না।
আরও পড়ুন : এমটিএফই অ্যাপে কোটিপতি নুরুন্নবী, নতুন ফাঁদ জিটিসি-এক্স
বিষয়টিতে বিএফআইইউ’র দায় আছে- উল্লেখ করে তানভীর হাসান জোহা বলেন, এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো দায় নেই। কারণ, তাদের এসব বিষয়ে যদি বিএফআইইউ না জানায়, তারা তো কিছুই জানবে না। যদি টাকা পাচার হয় তাহলে অবশ্যই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানার কথা।
‘এমটিএফই কোনো না কোনো এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করেছে। সেক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সিমের রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে মালিকদের গ্রেপ্তার করলে তো অনেক তথ্য বের হয়ে আসবে। আমরা জেনেছি, দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে এমটিএফই’র সিইও হওয়া যায়। তাদের যদি ৪০০ জন সিইও থাকে তাহলে এখানেই তো সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া প্রতি সিইও'র আন্ডারে আরও ৩০০-৪০০ জন লোক আছে।’
তবে, এত আলোচনা ও অভিযোগ উঠলেও এ বিষয়ে বিএফআইইউ’র সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আসলে বিএফআইইউ বিদেশে টাকা পাচার করেছে কি না, টাকা পাচার হলে তার পরিমাণ কত, সেটি বিএফআইইউ’র সিস্টেমে ধরা পড়েছে কি না, যদি ধরা পড়ে থাকে সে বিষয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছে কি না?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অর্থ পাচার করেছে কি না, জানি না। আমাদের কাছে তথ্য নেই। এ বিষয়ে বিএফআইইউ বলতে পারবে।
জানতে আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাসকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে তাকে এ সংক্রান্ত প্রশ্ন হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়। কোনো উত্তর দেননি তিনি।
আরও পড়ুন- ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তথ্য সহযোগিতা চায় সিআইডি
এদিকে, ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম নিয়ে কাজ করা সিআইডিও এমটিএফইর অর্থপাচার নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারছে না। সিআইডি সূত্রে জানা যায়, কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে- এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনও সিআইডির কাছে দেয়নি বিএফআইইউ।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, সুপরিকল্পিতভাবে এমটিএফই প্রতারণা করেছে। শুধুমাত্র শহর অঞ্চল নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকেও টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সিআইডির প্রাথমিক তদন্ত সূত্রে জানা যায়, এমটিএফইতে বড় লাভের আশায় ৫০০ ডলার থেকে ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত অনেকে বিনিয়োগ করেছেন। প্রথম দিকে কিছু টাকা লাভ এলেও দিন শেষে বিনিয়োগকারীরা সব টাকাই হারিয়েছেন।
এমটিএফই’র প্রতারণা নিয়ে তদন্ত চলমান থাকায় এ বিষয়ে সিআইডির সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে, এ বিষয়ে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জানান, অনলাইন বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডলার, শেয়ার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচায় কাজ করে কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ ইনকর্পোরেটেড। প্রতিষ্ঠানটিতে এমটিএফই কর্তৃক প্রতারিত ভুক্তভোগী ও গ্রাহকদের তথ্য সহায়তা চাইছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
শুধু এমটিএফই নয়, দেশে অনিবন্ধনকৃত মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক প্রতারক চক্রের এমএলএম ব্যবসা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ বলেও জানান তিনি। বলেন, সিআইডির সাইবার টিম এ বিষয়ে গভীর নজরদারি চালাচ্ছে। ভুক্তভোগী ও প্রতারিত গ্রাহকরা এ প্রতারক চক্রের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে বা অভিযোগ জানাতে সিআইডির সাইবার সাপোর্ট সেন্টারে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হলো।
যোগাযোগের ঠিকানা-
ফেসবুক পেজ: https://www.facebook.com/cpccidbdpolice/
ই-মেইল: [email protected]
24/7 কন্টাক্ট নম্বর: +8801320010148 অথবা জরুরি জাতীয় সেবা 999 এ জানাতে পারেন যে কোনো ভুক্তভোগী।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এমটিএফইর কত গ্রাহক আছে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। তবে, এমটিএফই’র হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মোট আট লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়; দুবাই, ওমান, কাতার সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এমটিএফইতে বিপুল পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশে তাদের কোনো অফিস নেই।
এমএসি/এমজে