জ্বালানি তেলে বেসরকারি ‘হাত’, লাভের গুড় যাবে কার জিবে?
দেশে জ্বালানি তেলের আমদানি ও সরবরাহ সরকারিভাবে করা হয়। ফলে সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সেই মূল্যে ভোক্তাদের জ্বালানি তেল কিনতে হয়। সরকারের একচেটিয়া প্রভাব বন্ধে অনেকদিন ধরে বেসরকারি খাতের অন্তর্ভুক্তির কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের দাবি, এতে করে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হবে এবং ন্যায্যমূল্যে জ্বালানি সেবা পাবেন ভোক্তারা।
সম্প্রতি ‘বেসরকারি পর্যায়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুত, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণন নীতিমালা-২০২৩’-এর খসড়া তৈরি করেছে সরকার।
নীতিমালায় বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিশোধিত তেল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিক্রির নিশ্চয়তা দেওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি পণ্য রপ্তানিরও সুযোগ রাখা হয়েছে।
অপরিশোধিত তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রিতে অংশগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে পাঁচটি বেসরকারি কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, পেট্রোম্যাক্স ও অ্যাকোয়া রিফাইনারি।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটায় একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তারা অপরিশোধিত তেল আমদানি করে এবং সেই তেল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধিত হয়ে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলসহ সরকারি বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। এর বাইরে সরকারি খাতের তিনটি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি রিফাইনারি (কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্ল্যান্ট) পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট গ্রহণের পর প্রক্রিয়াজাত করে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, সলভেন্ট, মোটর স্প্রিট, কেরোসিন সুপিরিয়র অয়েল, মিনারেল তারপেনটাইনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করে। এছাড়া বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো শর্তসাপেক্ষে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারে।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম জ্বালানি আমদানিতে বেসরকারি খাতের সংযুক্তির বিষয়টি উঠে আসে। সেসময় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’ প্রস্তাবনাটি অনুমোদনের জন্য ওঠে। বেসরকারি আমদানিকারকেরা পরিশোধিত তেল আমদানি করবে নাকি রিফাইনারির মাধ্যমে পরিশোধন করে নিজেরাই খোলা বাজারে বিক্রি করবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। যদি নিজেরা রিফাইন করে তাহলে মান ঠিক রাখার জন্য বিএসটিআইয়ের মনিটরিংয়ের বিষয়টিও উঠে আসে আলোচনায়।
আলোচনায় বাজারজাত পদ্ধতি নিয়ে বলা হয়, ক্রুড তেল আমদানির পর তা বিপিসির কাছে বিক্রি করবে আমদানিকারকরা। এরপর বিপিসি তা রিফাইন করে বাজারজাত করবে। আর আমদানিকৃত সেই তেলের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেবে।
এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে আর্থিক চাপ মোকাবিলা এবং জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করার পথে হাঁটছে সরকার। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও তা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে আগামী মাসে তা চূড়ান্ত হবে। জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের ওপর যে চাপ বাড়ছে এই নীতিমালা তা কমাতে সাহায্য করবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, রিফাইনারির চূড়ান্ত অনুমোদন প্রাপ্তি/থাকা সাপেক্ষে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান উৎপাদন ও ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে আবেদন করবে। চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর বিপিসির অনুকূলে ২৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করতে হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অপরিশোধিত তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রিতে অংশগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে পাঁচটি বেসরকারি কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, পেট্রোম্যাক্স ও অ্যাকোয়া রিফাইনারি।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূলত যারা রিফাইনারি করতে চায়, তাদের জন্য এই পদক্ষেপ। এখন আমাদের দেশের রিফাইনারি থেকে যে পেট্রোল-অকটেনটা পাই, এটা চাহিদা মিটিয়ে থাকে। সুতরাং, যে কোম্পানি দেশে রিফাইনারি করবে, তাকে তেল রপ্তানি করতে হবে।
তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হলো প্রতিযোগিতা গড়ে তোলা। বেসরকারিভাবে রিফাইনারি তৈরি হলে বিপিসির সাথে একটা কম্পিটিশন তৈরি হবে। কিন্তু তার সুফলটা ভোক্তারা পাবে না, যতদিন না এতে রেগুলেটরি কমিশনের সংযুক্তি থাকে।
তিনি আরও বলেন, আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাতে সিন্ডিকেটের প্রভাব দেখেছি। মুক্তবাজার তৈরি করতে হলে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানকে নয় বরং সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকেই তেল আমদানির সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এতে করে পাম্পগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তারাও তেল সরবরাহ করতে পারবে। তবে বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করার পর যদি তাতে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে জ্বালানি তেলের প্রাপ্তিতে ভোক্তা কোনো সুবিধা পাবে না।
আর্থিক চাপ মোকাবিলা এবং জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করার পথে হাঁটছে সরকার। এজন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে তা চূড়ান্ত হতে পারে। জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের ওপর যে চাপ বাড়ছে এই নীতিমালা তা কমাতে সাহায্য করবে।
লাভ ব্যবসায়ীদেরই, জনগণ সুবিধা পাবে না : ক্যাব
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, এই নীতিমালার মাধ্যমে মূলত ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। জনগণ কোনো সুফল পাবে না। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন যখন ছিল তখনই বিপিসির আয়-ব্যয়-মুনাফার হিসাব স্বচ্ছভাবে পাওয়া যেত না। আর এখন যেহেতু বিইআরসির নিয়ন্ত্রণের কোনো এখতিয়ার নেই, সেহেতু সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা একত্রেই কাজ করবে। এর ফলে কোনো প্রতিযোগিতাও তৈরি হবে না। ভোক্তারাও ন্যায্যতার ভিত্তিতে জ্বালানির সুবিধা পাবে না।
গোষ্ঠী সুবিধা নয় : বিপিসি
বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আমানুল্লাহ বলেন, জ্বালানি আমদানিতে বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করার নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। নীতিমালা অনুযায়ী যারা আবেদন করবে, তাদের আবেদন সরকার কর্তৃক গৃহীত হবে। অনুমোদনের পর তারা আমদানি করতে পারবে।
বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, এমন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এছাড়া মূল্য নির্ধারণের কাজটাও সরকারের মাধ্যমেই হবে।
ওএফ/এমজে