মিটিং প্রতি ২ লাখ টাকা ঘুষ চান আইডিআরএর সদস্য কামরুল
প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সিইও) জহির উদ্দিনের কাছে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সদস্য (লাইফ) কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জহির উদ্দিন।
গত ১২ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে ৩১টি পয়েন্ট সম্বলিত ১০ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন জহির উদ্দিন। তিনি বর্তমানে প্রগ্রেসিভ লাইফের কোম্পানি সচিব ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, আইডিআরএ সদস্য আমাকে এই বলে ঘুষ চান যে, ‘তোমার অনেক শত্রু, তুমি এখানে আসলে শুধু আমার সঙ্গে দেখা করবা, অন্য কারো সঙ্গে দেখা করবা না। হুমায়ুন (প্রগ্রেসিভ লাইফের সাবেক কর্মকর্তা) তোমাকে ভালো ও দক্ষ বলেছে, তাই তোমাকে আমি তার মাধ্যমে ডেকেছি। তুমি আমাকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে দিবা, আমি তোমাকে এমডি করে দেব।’
অভিযুক্ত কামরুল হাসান ভুক্তভোগী জহিরকে আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও মেয়ে আমেরিকায় থাকে, তাদের টাকা পাঠাতে হয়। আমি খুব কম বেতন পাই, তাই আমার চলে না। গাড়ির ২০০ লিটার জ্বালানি সরকার দেয়, তাতে চলে না, গুলশান যেতে আসতে শেষ হয়ে যায়। প্রতি মাসে ৫০ হাজার এবং আমাকে নিয়ে বিমা দাবি পরিশোধ মিটিং করে প্রতি মিটিংয়ে ২ লাখ টাকা করে সম্মানী দিবা’।
জহির বলেন, গত ১১ জুন কামরুল হাসান, তার কক্ষে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘ঈদের জন্য তুমি আমাকে ১ লাখ টাকা দেবে। টাকা না দিলে তোমাকে কোম্পানি থেকে বের করে দেব।’
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির এমন অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও ২০২২ সালে ১৪ জুন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন ঘুষ কেলেঙ্কারির জেরে পদত্যাগ করেন। বিমা খাতের কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স থেকে ঘুষ নিতে চেয়েছিলেন তিনি।
এবার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ উঠল প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (লাইফ) কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন। আর এ দুর্নীতির কারণেই বিমা খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো অভিযোগপত্রে ৩১টি পয়েন্টে কামরুল হাসানের ঘুষ দাবিসহ নানা অনিয়মের কথা উত্থাপন করেছেন প্রগ্রেসিভ লাইফের ভারপ্রাপ্ত সিইও জহির উদ্দিন। এর মধ্যে প্রথম সাতটি পয়েন্ট তিনি তার ৩০ বছরের বিমা খাতের কর্মজীবন ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। আর আইডিআরএ সদস্য কীভাবে ঘুষ চেয়েছেন তার বিস্তারিত তথ্য ২৪টি পয়েন্টে উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে জহির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি প্রগ্রেসিভ লাইফ কোম্পানির ডিএমডি হয়েছি। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আমাকে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানি করছেন আইডিআরএর সদস্য। তিনি মানসিকভাবে নির্যাতন করছেন। এটা বিমা খাতের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।’
জহির উদ্দিন বলেন, ‘আমি ন্যায় বিচার থেকে বারবার বঞ্চিত হয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএর চেয়ারম্যানের কাছে অসংখ্যবার আবেদন করেছি, বিচার পাইনি, প্রতিকারও পাইনি। তাই উপায় না পেয়ে সচিবের দ্বারস্থ হয়েছি। সচিবের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেছি, সঙ্গে সমস্ত কাগজপত্র দিয়েছি প্রমাণের জন্য।’
৩২ বছর বিমা শিল্পে কাজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রথমে ন্যাশনাল লাইফে ১১ বছর, এরপর একজন মন্দ লোকের কাছে পড়েছি, কিন্তু তার বিচার পাইনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, মার খেতে খেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, একসময় মনে হয় আত্মহত্যা করে ফেলি।’
তিনি বলেন, ‘আমি দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে, সুনাম ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এমনকি ঘুষ না দেওয়ায় আমাকে বিমা সেক্টর থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তার সব প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।’
এ বিষয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান জয়নুল বারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার কাছে এমন কোনো অভিযোগ কেউ করেননি। আমি অসুস্থতার জন্য ছুটিতে আছি। মন্ত্রণালয়ে অভিযোগের বিষয়ে এখনো জানি না।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে অভিযুক্ত আইডিআরএর সদস্য কামরুল হাসানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কে এই কামরুল হাসান?
কামরুল হাসান ২০২২ সালের ২৩ জুন আইডিআরএর সদস্য (লাইফ) হিসেবে তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। তিনি ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ টেক্সাস থেকে বিবিএ এবং ১৯৯৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিচেস্টার থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
তারপর ২০০৩ সালে লাইফ ইনস্যুরেন্স বিষয়ে এফএলএমআই ডিস্টিংশন অর্জন করেন। সেটিও করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার লাইফ অফিস ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস (এলওএমএ) থেকে।
আইডিআরএতে যোগদানের আগে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী হয়েছিলেন ২০১৬ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ঋণ খেলাপি হওয়ার মাত্র ২৬ দিনের মাথায় ২০১৬ সালের ১০ মার্চ তার নিয়োগ অনুমোদন প্রত্যাহার করে নেয় আইডিআরএ।
পদ্মা ইসলামী লাইফের আগে কামরুল হাসান প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্সের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মেটলাইফের ক্লেইম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন।
এমআই/এসকেডি