শেয়ার ব্যবসায়ীদের কষ্টের আরেক ঈদ
গত এপ্রিলে রমজানের ঈদের আগে বাজার ভালো না থাকায় মুনাফা করতে পারেননি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা। সে কারণে হতাশায় ঈদ কাটে তাদের। ঈদের পর কিছুদিন ঊর্ধ্বমুখী হলেও তা ধরে রাখতে পারেনি বাজার। তারপর বেশ কয়েকদিন নিম্মমুখী ছিল পুঁজিবাজার। যে কারণে কোরবানির ঈদেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। ফলে পুঁজিবাজারের সাড়ে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর অধিকাংশই পার করছেন কষ্টের আরেক ঈদ।
শুধু বিনিয়োগকারীই নয়, শেয়ার ব্যবসায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হতাশা ও মলিন মুখের ঈদ এটি। কারণ বেশিরভাগ ব্রোকার হাউজের মালিকরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দিতে পারেননি।
দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যভুক্ত ব্রোকার হাউজের সংখ্যা সাড়ে তিন শতাধিক। এর মধ্যে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি ব্রোকার হাউজের মালিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের সঙ্গে ঈদ বোনাস দিয়েছেন। অধিকাংশ ব্রোকার হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হয় বেতন নতুবা বোনাস পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ বেতন-বোনাস কিছুই পাননি।
নাম না প্রকাশের শর্তে একটি ব্রোকার হাউজের এমডি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রধান শাখা ছাড়াও আমার সাতটি শাখা রয়েছে। আমার অফিসে মোট ১২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। ব্যবসা ভালো না যাওয়ার কারণে কাউকে বেতন-বোনাস দিতে পারিনি। আমার ৩৩ বছর শেয়ার ব্যবসার জীবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। আমি নিজে প্রতি বছর দুটি গরু কোরবানি দিতাম, এবার দুই ভাই মিলে একটি গরু কোরবানি দিচ্ছি।
লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আজিজুল ইসলাম অনিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কয়ার, বেক্সিমকো ফার্মাসহ ৭টি কোম্পানির শেয়ারে আমার বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু ৫টি কোম্পানির শেয়ার আটকা রয়েছে ফ্লোর প্রাইসে। এ কারণে শেয়ার বিক্রি করতে পারিনি। ঈদের খরচও মেটাতে পারিনি।
আইডিএলসি সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মুনশি আহমদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবারের ঈদের আগে কেবল বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। আমার কাছে রয়েছে টেক্সটাইল ও বিদেশি কোম্পানির শেয়ার। এগুলোর দাম বাড়েনি, তাই কোনো মুনাফা হয়নি। ফলে আমার ঈদ আনন্দ নেই।
আজিজুল ইসলাম ও আহমদ হোসেনের মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর শেয়ার গত এক মাস, দুই, ছয় কিংবা এক বছর ধরে ফ্লোর প্রাইসে আটকা আছে। এই বিনিয়োগকারীরা একদিকে ক্যাপিটাল গেইন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না ফ্লোর প্রাইসের কারণে। বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজারে ২ শতাধিক কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকা রয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের এক পরিচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজারে সব কিছুর মূল্য ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের আয় বাড়েনি। তার মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের অবস্থা তো আরও খারাপ। বিনিয়োগকারীদের গত এক বছর কোনো মুনাফা হয়নি। ফলে তাদের ঈদের কোনো আনন্দ নেই।
তিনি অভিযোগ করেন বলেন, ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেও অনেক বিনিয়োগকারী ঈদের আগে শেয়ার বিক্রি করতে পারেনি। অর্থাৎ শেয়ার থাকার পরও বিক্রি করতে না পারায় ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ বিনিয়োগকারী।
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব বিনিয়োগকারীর ক্যাপিটাল গেইন হয়েছে তাদের ঈদ ভালো হয়েছে। যাদের ক্যাপিটাল গেইন হয়নি তাদের ঈদ ভালো হচ্ছে না। যারা বিনিয়োগ করে ধরা খেয়েছেন কিংবা বাজে শেয়ারে বিনিয়োগ করে এখন পস্তাচ্ছেন তাদেরও ঈদ নেই।
ক্যাপিটাল গেইন কিছু বিনিয়োগকারীর হলেও ব্রোকারদের ঈদ আনন্দ নেই বলে মন্তব্য করেছেন আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, ব্রোকারদের কোনো ঈদ নেই। আমার অনেক পরিচিত ব্রোকার এই ঈদে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বোনাস দিতে পারেনি। বোনাস দেওয়ার ইচ্ছে নেই বিষয়টা এমন নয়, ব্যবসা ভালো না থাকার কারণে বোনাস দেওয়া হয়নি।
বোনাস না দিতে পারার কারণ লেনদেন কম জানিয়ে তিনি বলেন, বাজারে এই টার্নওভারে কোনোভাবে ব্রোকারের ভালো ব্যবসা করা সম্ভব না। কোনো ব্রোকার ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছে না। এটা হয়েছে ফ্লোর প্রাইসসহ বিভিন্ন কারণে। প্রতিনিয়তই পুঁজিবাজারে প্রতি বিনিয়োগকারীদের যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, বাজারের জন্য তা ভালো না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারে ৮০ শতাংশ শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকা রয়েছে। ভালো ভালো কোম্পানির এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করেও বিক্রি করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। ফলে তাদের ঈদে আনন্দ মলিন।
এমআই/জেডএস