আসছে নতুন পুঁজি, ভাঙছে ফ্লোর প্রাইস
নতুন করে পুঁজিবাজারে আসছে শত কোটি টাকার স্মার্ট ফান্ড। এ ফান্ডের অর্থ বিমা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং ওষুধ খাতের শেয়ারে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কয়েকটি ছোট মূলধনি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এমন খবরে মাসের ব্যবধানে ৪০টি কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ভেঙে তার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। পুঁজিবাজারও চলছে বেশ ইতিবাচক প্রবণতায়।
এ অবস্থায় গত ৩ মে থেকে চলতি মাসের ৪ জুন পর্যন্ত সময়ে নতুন করে প্রায় দেড় হাজার বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে এসেছেন। একই সময়ে সক্রিয় হয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা। ফলে বিনিয়োগকারীদের লেনদেন ৫০০ কোটি টাকার ঘর থেকে এক হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। ১৪ লাখ তিন হাজার বিওধারী বিনিয়োগকারীর আট হাজার ৬১৬ কোটি ৮২ লাখ দুই হাজার টাকার হারানো পুঁজি ফিরেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো কোম্পানির ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস উঠে যাওয়া পুঁজিবাজারের জন্য সুসংবাদ। সবাই চায় পুঁজিবাজার ভালো হোক।
ডিএসইর পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ঈদের পর থেকে পুঁজিবাজার ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে। বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইস অতিক্রম করেছে। ট্রেডিং ভলিউমও ভালো হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এবং ডলারের বাজার স্থিতিশীল হলে পুঁজিবাজার দ্রুত চাঙা হবে।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইস থেকে উঠে আসছে। এটা বিনিয়োগকারীদের জন্য সুসংবাদ। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পুঁজিবাজারের জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। কোনো রকম অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউজের এমডি ঢাকা পেস্টকে বলেন, গত মে-জুন মাসে বাজারে দুটি পার্টি বিমা খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতের কয়েকটি শেয়ারে নতুন করে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ফলে কোনো কারণ ছাড়াই এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে। এক থেকে দেড় মাসে ২০ থেকে ২৫টি কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। এখন সেই গোষ্ঠী মেঘনা ও রূপালী লাইফসহ বেশকিছু শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে। বেশি মুনাফা করতে গিয়ে অতিমূল্যায়িত শেয়ারে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বাজারে নতুন করে স্মার্ট মানি ঢুকছে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ স্মার্ট মানি ঢোকার কারণে গত রোজার ঈদের পর থেকে বাজার বেশ সুন্দরভাবে ভলিউম করে পজিটিভ একটা ধারায় চলছে। অনেক বিনিয়োগকারী আস্থা খুঁজে পাচ্ছেন। অনেক শেয়ার অতিমূল্যায়িত যেমন হয়েছে, তেমনি অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইস অতিক্রম করেছে এবং বাজারে তারল্য বাড়িয়েছিল।
তিনি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, হঠাৎ করে গত কয়েক দিন নেতিবাচক ধারায় চলছে বাজার। আমি বাজারে এমন অবস্থা হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছি না। বলা হচ্ছে, মুদ্রানীতি, জুন অ্যাডজাস্টমেন্ট, সামনে কোরবানির ঈদ। কিন্তু আমি মনে করি এসব কোনো কারণ নয়। একটা চক্র পরিকল্পিতভাবে, ধীরে ধীরে আস্থা ফিরে আসা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে এমন করছে। যেসব শেয়ারের মূল্য বেড়েছে, সেখানে যে কেউ চাইলে মুনাফা তুলে নিতে পারে। তাই বলে যেসব শেয়ারের মূল্য তেমন বাড়েনি, সেসব শেয়ারের দাম কমে যাওয়ার তো কোনো ব্যাখ্যা নেই। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ করব, কারা এমন করছে খুঁজে বের করতে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বলব, গুজবে কান না দিয়ে অপেক্ষা করুন। বাজার খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাজার যখন তলানিতে থাকে তখন বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি কম থাকে। আবার বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন যেকোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ হচ্ছে, শেয়ারটির দাম কমতে পারে। এ সময় বিনিয়োগ করলে যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ২৫২টির শেয়ার ছিল ফ্লোর প্রাইসের বৃত্তে। সেখান থেকে দাম বেড়ে ফ্লোর প্রাইসের ওপরে লেনদেন হয়েছে ৪০টি কোম্পানি। তাতে গত ৪ জুন ফ্লোর প্রাইসের মধ্যে থাকা কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়ায় ২১২টি।
‘বিনিয়োগকারীদের উচিত দেখে-শুনে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করা। যেসব শেয়ার নিয়ে খেলা হয় সেসব কোম্পানির শেয়ার থেকে দূরে থাকা।’
নতুন অর্থ বিনিয়োগের খবরে ফ্লোর প্রাইস ভেঙেছে
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ২৫২টির শেয়ার ছিল ফ্লোর প্রাইসের বৃত্তে। সেখান থেকে দাম বেড়ে ফ্লোর প্রাইসের ওপরে লেনদেন হয়েছে ৪০টি কোম্পানি। তাতে গত ৪ জুন ফ্লোর প্রাইসের মধ্যে থাকা কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়ায় ২১২টি।
ডিএসইর তথ্য মতে, গত ৩ মে বিমা খাতের কোম্পানি ইসলামিক ইনস্যুরেন্স এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের দাম বেড়ে ফ্লোর প্রাইস থেকে উঠে আসে। ঠিক একইভাবে গত ৪ জুন মীর আক্তার ও কনফিডেন্স সিমেন্টের শেয়ারের দাম বেড়ে ফ্লোর প্রাইস অতিক্রম করে।
বিও অ্যাকাউন্ট এক হাজার ৩৫১টি বেড়ে গত ৪ জুন দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৭২ হাজার ৪৯০টিতে। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৯৮৩টিতে। আর ১৮ লাখ ৭২ হাজার বিও হিসাবের মধ্যে বর্তমানে শেয়ার রয়েছে এমন বিও হিসাব ছিল ১৪ লাখ তিন হাজারের কিছু বেশি।
ফ্লোর প্রাইস ভেঙেছে এশিয়া ইনস্যুরেন্স, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, প্রভাতি ইনস্যুরেন্স, গ্রিনডেল্টা ইনস্যুরেন্স, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইনস্যুরেন্স, মেঘনা ইনস্যুরেন্স, গ্লোবাল ইনস্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স, প্রভাতি ইনস্যুরেন্স, রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স, তাকাফুল ইনস্যুরেন্স, প্রোগ্রেসিভ লাইফ, ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্স,পদ্মা লাইফ ইনস্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স, সন্ধানী ইনস্যুরেন্স, প্রগ্রেসিভ লাইফ, স্ট্যান্ডার্ড ইনস্যুরেন্স, সোনার বাংলা ইনস্যুরেন্স, ফনিক্স ইনস্যুরেন্স, পিপলস ইনস্যুরেন্স, পাইওনিয়র ইনস্যুরেন্সসহ বেশির ভাগ বিমা কোম্পানির।
ব্যাংক খাতের মধ্যে প্রাইম ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং ডাচ বাংলা ব্যাংকসহ বেশকিছু ব্যাংকের। মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে রয়েছে- গোল্ডেন জুবলি মিউচুয়াল ফান্ড ও আইসিবি সোনালী মিউচুয়াল ফান্ড।
এছাড়াও রয়েছে- পদ্মা অয়েল, এনার্জি পাওয়ার জেনারেশন, ন্যাশনাল হাউজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, এমজেএল বিডি, বিডি থাই ফুড, ঢাকা ডাইং, সিলকো ফার্মা, রহিম টেক্সটাইল, কে অ্যান্ড কিউ, ইমাম বাটন, জেনারেশন নেক্সট, ক্রাউন সিমেন্ট, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, জাহিন স্পিনিং ও ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশনসহ ৪০টি কোম্পানির শেয়ার।
সার্বিক বাজার
গত ৩ মে থেকে ৪ জুন সময়ে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। তাতে ডিএসইর প্রধান সূচক আগের মাসের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বেড়ে ছয় হাজার ৩৬৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। সূচক বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের হারানো পুঁজি আট হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৭৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৩২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। যা গত ৩ মে ছিল সাত লাখ ৬৬ হাজার ৩১৭ কোটি ৫০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
নতুন বিনিয়োগকারী এসেছে দেড় হাজার
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য মতে, গত ৩ মে বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্টের (বিও) সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৭১ হাজার ১৩৯টি। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও ছিল ১৭ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭টি।
এক মাসের ব্যবধানে সেই বিও অ্যাকাউন্ট এক হাজার ৩৫১টি বেড়ে গত ৪ জুন দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৭২ হাজার ৪৯০টিতে। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৯৮৩টিতে। আর ১৮ লাখ ৭২ হাজার বিও হিসাবের মধ্যে বর্তমানে শেয়ার রয়েছে এমন বিও হিসাব ছিল ১৪ লাখ তিন হাজারের কিছু বেশি।
এমআই/এসকেডি