সংকটের সময়ও বাড়ছে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব
>> কোটি টাকার হিসাব ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২টি
>> এক বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৫৯৫টি
আর্থিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যেও দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে কমপক্ষে এক কোটি টাকা বা এর চেয়ে বেশি অর্থ রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
মূল্যস্ফীতির চাপে যেখানে সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় মেটাতে পারছে না, ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারছে না; ব্যাংকে টাকা জমানো পরের কথা অনেকে আগের জমানো অর্থ তুলে ব্যয় মেটাচ্ছেন; এমন পরিস্থিতিতেও এক শ্রেণির মানুষের আয় বেড়ে যাওয়াকে দেশে বৈষম্য বাড়ার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
মঙ্গলবার (১৩ জুন) প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৩ সালের মার্চ ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ২৫৬টি। এসব অ্যাকাউন্টে মার্চ পর্যন্ত জমা ছিল ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা বা তার বেশি অর্থ আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ১৯২টি। কমপক্ষে ১ কোটি টাকা থাকা এসব হিসাবে জমা আছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন : ‘সংকটেও’ বাড়ছে ধনীদের হিসাব
২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬৪টি। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা বা তার বেশি আমানত থাকা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। এসব হিসাবে জমা ছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
এক বছর আগে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকে মোট হিসাব ছিল ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৩। এসব হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। ওই সময় কোটি টাকা বা তার বেশি আমানতের হিসাব ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭টি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে ব্যাংকগুলোতে এক বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে ৬ হাজার ৫৯৫টি। তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২৪৬টি।
আরও পড়ুন : শিথিলতার সুযোগে ২৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ ‘খেলাপিমুক্ত’
চরম আয় বৈষম্যের প্রতিফলন
কোটি টাকার হিসাব বাড়ছে মানে দেশে ‘আয় বৈষম্য’ চলছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশকিছু আর্থিক সূচকে আমাদের অবস্থা নেতিবাচক। মূল্যস্ফীতির চাপে এখন মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এমন সময় কোটি টাকার হিসাব বাড়ছে মানে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের কাছে আয় সীমাবদ্ধ আছে। এখন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর উচিত এসব টাকা বৈধ কি না তার তদারকি করা। যদি বৈধ হয় তাহলে ভালো, আর যদি অবৈধ হয় তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
৫০ কোটির বেশি টাকা আছে ১ হাজার ৭৫৮ হিসাবে
কোটি টাকার হিসাবগুলোকে ১০টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ১০১টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১২ হাজার ৪০টি হিসাব। তাদের হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৪ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন : সঞ্চয় করবেন, কোন ব্যাংকে কত মুনাফা জানুন
এছাড়া ১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে তিন হাজার ৮৭৫টি, ১৫ কোটি ১ টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১৮৭৪টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ১৪৫টি, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৭ জনের, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৯৯টি এবং ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩২৭ আমানতকারীর হিসাব। ৪০ কোটি ১ টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৬৪৬টি। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫৮টি। এসব হিসাবে জমার পরিমাণ ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।
১৯৭২ সালে ছিল ৫টি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটি টাকার হিসাব ছিল ৫টি, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭টিতে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে এমন হিসাব ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি, ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতি হিসাব দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯৭৬টিতে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি।
কোটি টাকার যত হিসাব দেশে তত কোটিপতি?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব তা নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।
এসআই /এসকেডি/জেএস