মানি লন্ডারিং নিয়ে ‘ঘুমিয়ে থাকা’র অপবাদ ঘুচাতে তৎপর দুদক
একসময় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অর্থপাচারসহ সব অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের একমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৫ সালে আইনটি সংশোধন করে ২৭টি অপরাধের মধ্যে শুধু ঘুষ ও দুর্নীতি (একটি অপরাধ) থেকে উদ্ভূত মানি লন্ডারিং দুদকের আওতায় রেখে বাকিগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য সরকারের ছয়টি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে দেশি-বিদেশি মুদ্রাপাচার, জালিয়াতি ও প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ থেকে উদ্ভূত মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অন্যান্য অপরাধ দুদকের এখতিয়ারের বাইরে চলে যায়।
অথচ মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগ উঠলে সবচেয়ে বেশি দায় নিতে হয় দুদককে। এমনকি সম্প্রতি দেশের উচ্চ আদালতেও বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার হওয়া এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ‘দুদক ঘুমিয়ে আছে’ বলে মন্তব্য করা হয়।
তাই মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত সব অপরাধ তদন্তে আগের ক্ষমতা ফিরে পেতে আইন ও বিধি সংশোধনের সরকারি উদ্যোগ চায় দুদক। সে লক্ষ্যে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি।
গত বছরের ৩০ আগস্ট মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয় কমিটির ২৬তম সভায় এ নিয়ে জোরালো বক্তব্য রাখেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।
ওই সভায় জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, বিধিমালা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও দলিলাদি যাচাইয়ের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (বিএফআইডি) একটি প্রস্তাবনা প্রস্তুতের নির্দেশ দেন।
এরপর অর্থমন্ত্রণালয়ের বিএফআইডি’র সচিবের সভাপতিত্বে দুদক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর এ বিষয়ে আরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভায় বিধিমালা (তফসিলসহ) সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রস্তাব চায় দুদকের কাছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওই অনুরোধের প্রেক্ষিতে গত ২৯ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে প্রস্তাবনা পাঠায় দুদক।
দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সই করা চিঠির সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কমিশনের সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২ (ঠ) ধারা সংশোধন করতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯ এর তফসিলে বর্ণিত অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য নির্ধারিত সংস্থার তালিকার ক্রমিক নং ৩, ৫, ৬, ১৪, ১৮, ১৯ ও ১৫ যথাক্রমে দলিল দস্তাবেজ জালকরণ, প্রতারণা, জালিয়াতি, দেশি ও বিদেশি মুদ্রা পাচার, চোরাচালান ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ, কর সংক্রান্ত অপরাধ, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত অপরাধ (ইনসাইডার ট্রেডিং অ্যান্ড মার্কেট ম্যানিপুলেশন) থেকে উদ্ভূত মানি লন্ডারিং তদন্তের এখতিয়ার অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি দুদককেও প্রদানের লক্ষ্যে তফসিলসহ বিধিমালা সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অনুরোধ করা হয়।
এরপর গত বছরের ১১ ডিসেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে দুদক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২ (ঠ) এর সংশ্লিষ্ট ধারা ও বিধিমালা (তফসিলসহ) সংশোধনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দুদকের প্রস্তাব চাইলে তা পাঠানো হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত ২৭টি অপরাধের মধ্যে কেবল ঘুষ ও দুর্নীতি থেকে উদ্ভূত মানিলন্ডারিং অপরাধ দুদকের আওতায় থাকায় আমাদের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের প্রস্তাব হলো, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আমরাও যেন বাকি ২৬টি অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের এখতিয়ার পাই। এ বিষয়ে আমাদের উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অর্থপাচারের পরিমাণ বাড়ছে। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থপাচারের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয় আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। অথচ বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইনে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে না দুদক। এর বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত হলে তারও তদন্তের ক্ষমতা দুদকের এখতিয়ারের বাইরে।
দুদকের ক্ষমতা না থাকায় এরই মধ্যে পানামা পেপারস; প্যারাডাইস পেপারস; প্যান্ডোরা পেপারস; মালয়েশিয়ার মাই সেকেন্ড হোম প্রকল্প; কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থপাচারের মতো ঘটনাগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত করা যাচ্ছে না। এগুলো তদন্তের জন্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে ফাইল পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। যে কারণে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব ধরনের অর্থপাচারের অপরাধ তদন্তের সুযোগ রেখে আইনের সংশোধন চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রথম চিঠি দেয় দুদক।
মানি লন্ডারিং আইনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ আইনে বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং অপরাধ তদন্ত করতে পারতেন। এরপর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ-২০০৮ জারি করা হয়। ওই অধ্যাদেশের অধীন ১৭টি প্রেডিকেট অফেন্স থেকে উদ্ভূত সব মানি লন্ডারিং এককভাবে শুধু দুদক কর্তৃক তদন্তযোগ্য ছিল। পরে অধ্যাদেশটি বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ আইনেও সব মানি লন্ডারিং এককভাবে শুধু দুদক কর্তৃক তদন্তযোগ্য ছিল।
কিন্তু মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ-২০১২ জারি করা হয়। যা পরবর্তীতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ হিসেবে জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১২ সালের সংশোধিত আইনে ১৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের পরিবর্তে ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধ প্রতিস্থাপন করা হয় এবং এসব অপরাধ এককভাবে দুদক কর্তৃক তদন্তযোগ্য করা হয়। অর্থাৎ ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের শুরুতে সব সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র সংস্থা ছিল দুদক।
২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করা হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে শুধু একটি (ঘুষ ও দুর্নীতি) অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদককে। ২০১৬ সালের ২১ জুন এটি দুদক আইনে তফসিলভুক্ত করা হয়।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২৭টি প্রেডিকেট অফেন্স অনুসন্ধান-তদন্তের জন্য সাতটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংস্থাগুলো হলো- দুদক, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ কাস্টমস, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), পরিবেশ অধিদপ্তর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ অনুসারে ওই সাতটি সংস্থা তাদের ওপর নির্ধারিত প্রেডিকেট অফেন্সের অনুসন্ধান-তদন্ত করবে। বিধিমালা অনুসারে ‘দুর্নীতি ও ঘুষ’ সম্পৃক্ত একটি অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্তের ভার এককভাবে দুদককে দেওয়া হয়। এনবিআরকে ‘কর সংক্রান্ত অপরাধ’ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে ‘পুঁজিবাজার সংক্রান্ত অপরাধ (ইনসাইডার ট্রেডিং অ্যান্ড মার্কেট ম্যানিপুলেশন)’ এককভাবে অনুসন্ধান-তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়।
‘মুদ্রা জালকরণ’, ‘দলিল-দস্তাবেজ জালকরণ’, ‘চাঁদাবাজি’, ‘প্রতারণা’, ‘জালিয়াতি’, ‘অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা’, ‘অপহরণ, অবৈধভাবে আটকে রাখা ও পণবন্দি করা’, ‘খুন ও মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি’, ‘নারী ও শিশু পাচার’, ‘চুরি/ডাকাতি/দস্যুতা/জলদস্যুতা/বিমান দস্যুতা’, ‘মানবপাচার’, ‘যৌতুক’, ‘মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন’, ‘সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থ জোগান’, ‘ভেজাল বা স্বত্ব লঙ্ঘন করে পণ্য উৎপাদন’, ‘যৌন নিপীড়ন’, ‘সংঘবদ্ধ অপরাধ’, ‘ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়’- এই ১৮টি সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্তের ভার এককভাবে সিআইডিকে দেওয়া হয়।
এছাড়া বাকি ছয়টি সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা যৌথভাবে বিভিন্ন পক্ষকে দেওয়া হয়। ‘অবৈধ মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা’ সম্পৃক্ত অপরাধ যৌথভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সিআইডি, ‘চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা’ সংক্রান্তি অপরাধ বাংলাদেশ কাস্টমস ও সিআইডি, ‘চোরাকারবার’ এনবিআর ও সিআইডি, ‘দেশি ও বিদেশি মুদ্রাপাচার’ এনবিআর ও সিআইডি; ‘চোরাচালান ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ’ এনবিআর ও সিআইডি, ‘পরিবেশগত অপরাধ’ পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিআইডিকে যৌথভাবে অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়।
আরএম/জেডএস