গলা ভেজাতেও এবার গুনতে হবে বাড়তি টাকা
চৈত্রের গরমের মধ্যেই এবার শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। ভ্যাপসা গরমে দিনভর রোজা রেখে ইফতারে ঠান্ডা শরবত পান করতে চাইবেন রোজাদাররা। কিন্তু এবার সেটাও সবার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ বাজারের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির তালিকা থেকে বাদ যায়নি শরবত বানানোর উপাদান। রোজা শুরুর আগেই শরবত বানানোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লেবুর দাম আকাশচুম্বী। পিছিয়ে নেই অন্যান্য উপাদানও।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত মানুষের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা বলেন, রোজার আগেই সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে, যা এখনো অব্যাহত আছে। কিন্তু সেই হারে আয় বাড়েনি। ফলে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে নানা হিসাব কষতে হচ্ছে। কাজেই নিত্য দিনের খরচের বাইরে নতুন কিছু যুক্ত করতে হলে অন্য খরচে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় রোজায় প্রতিদিনের ইফতারে কী কী রাখা হবে সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখো গেছে, প্রকার ভেদে লেবুর দাম বেড়েছে ৩ থেকে চার গুণ। ২০ টাকার লেবু এখন প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। একইভাবে বেড়েছে শরবত তৈরির অন্যান্য উপাদান চিনি, ভুসি ও রুহ আফজার দাম।
রাজধানীর শান্তিনগর বাজারের ব্যবসায়ী শাজিদুল ইসলাম বলেন, এক সপ্তাহ আগে লেবুর হালি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। রোজাকে কেন্দ্র করে প্রতি হালি লেবু আজ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। বাড়তি দাম দিয়েও আজ বাজারে গিয়ে লেবু পাইনি।
শান্তিনগর কাঁচাবাজারে আসা আনিসুর রহমান মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, লেবু, চিনি, ভুসিসহ সব পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। রোজা শুরু হচ্ছে কিন্তু কীভাবে জিনিসপত্র কিনব সেই চিন্তা করে কুল কিনারা পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, গতবার যে চিনি ৮০ টাকা করে কেজি কিনেছি সেটা এবার ১২০ টাকা। এক পিস লেবুর দাম ১৫ টাকা। এটা কী করে সম্ভব! এবার রোজা শুরু হচ্ছে তীব্র গরমের মধ্যে। তাই ইফতারে শরবত পান করা জরুরি। কিন্তু এতো দামে লেবু কিনে কীভাবে শরবত খাব?
সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের মামা ভাগিনা জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন মিন্টু বলেন, রোজা আসার আগেই চিনি, ট্যাং, ইসবগুলের ভুসিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। শরবত তৈরির প্রত্যেকটি উপাদানের দাম প্রায় অর্ধেক বেড়েছে। ফলে বিক্রি কমেছে। আমাদের ব্যবসাও কমেছে। এখন দোকান ও কর্মচারীসহ অন্যান্য খরচের পর আর লাভ থাকে না।
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫ সদস্যের একটি পরিবারের রোজায় লেবু ও ইসবগুলের ভুসি দিয়ে তৈরি শরবতের জন্য খরচ পড়বে ২ হাজার ১০০ টাকা। তার সঙ্গে রুহ আফজা যোগ করলে খরচ পড়বে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ একই পানীয় পানে গত বছর এ পরিবারের খরচ হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
সাধারণত ৫ সদস্যের পরিবারে রোজার মাসে ৪ থেকে ৫ কেজি চিনির প্রয়োজন হয়। এতে খরচ হবে ৫৫০-৬০০ টাকা। ইসবগুলের ভুসি লাগতে পারে ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম। তাতে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা খরচ হবে। দিনে দুটি করে ৩০ দিনে ৬০টি লেবু প্রয়োজন হবে। তাতে খরচ হবে ৯০০ টাকা। দুই কেজি ট্যাং এর মূল্য ১ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়াও এক লিটার রুহ আফজার জন্য লাগবে ৩৬০ টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, প্রায় সব দেশে ধর্মীর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পণ্যের দাম কমানো হয়। বাংলাদেশে তার ঠিক উল্টো অবস্থা। প্রতিবছরই ব্যবসায়ীরা রোজার আগের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে দেন। আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে শরবত জাতীয় পণ্যের দাম রোজার আগেই ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যা কখনো কাম্য নয়। সঠিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত দাম সহনীয় পর্যায়ে আনার দাবি জানাই।
সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী রিপন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে বেঁচে থাকাই দায়। একদিকে জিনিসের দাম বেশি, অন্যদিকে লাভ কম। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, আগে ১০০ টাকার পণ্য কেনা বেচা হলে ১৫ থেকে ২০ টাকা লাভ থাকত। এখন থাকে ৫ থেকে ৬ টাকা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৯০০ টাকা বিনিয়োগ করেও ১০ টাকা লাভ থাকে।
বেসরকারি চাকরিজীবী হাসিবুর রহমান চার সদস্যের পরিবার নিয়ে রাজধানীর মিরপুরে বসবাস করেন। রোজার আগে সংসারের সদাই করতে কারওয়ান বাজারে এসেছেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সারাদিন রোজা রাখার পর তো শরবত ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে এবার জিনিসপত্রের যা দাম তাতে তৃপ্তি সহকারে শরবতও পান করতে পারব না।
বাজার মনিটরিং প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। যা এক বছর আগে ছিল ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। কেজিতে ৩৭ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়েছে।
১০ থেকে ১৫ টাকা হালির লেবু বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। যা এক মাস আগেও ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা হালি। এক বছর আগে ২ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ট্যাং বিক্রি হয়েছে ১৫০০ টাকায়। বর্তমানে ২ কেজি ওজনের ট্যাং বিক্রি হয়েছে ১৫০০ টাকা।
এক লিটার রুহ আফজা বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকায়। এক বছর আগে ছিল ৩০০ টাকা। অর্থাৎ লিটারে দাম বেড়েছে ৬০ টাকা।
ইসবগুলের ভুসি প্রতি কেজি গত বছর বিক্রি হয় ১০০০ থেকে ১১০০ টাকায়। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
এমআই/এসকেডি