বিনিয়োগের ৭০০ কোটি টাকা উদ্ধার অনিশ্চিত, মুনাফায় ধস আইসিবির
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণাধীনসহ আর্থিক খাতের নয়টি প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৬৬৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এছাড়াও তিনটি মিউচুয়াল ফান্ডে ৪৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও লোকসানের মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অর্থাৎ ১২টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা ৭১৫ কোটি টাকার উদ্ধার অনিশ্চিত হয়েছে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এছাড়া গত বছরের ২৮ জুলাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করায় এবার মুনাফায়ও ধসের মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এই অবস্থা থেকে উত্তোরণে মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে আইসিবি। এরই মধ্যে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণাধীনসহ আর্থিক খাতের নয়টি প্রতিষ্ঠানের পলাতক মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে আইসিবি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা শেয়ারগুলো কেনা-বেচার চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন করে ফান্ড বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নীতি সহায়তার জন্য আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মুনাফায় ধস:
অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ছয়মাসে কর পরবর্তী আইসিবির মুনাফা হয়েছে ৪৬ কোটি ৫০ লাখ ৩ হাজার ৬৪৫ টাকা। তাতে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৫৫ পয়সা।
২০২১ সালের ছয়মাসে আইসিবির মুনাফা হয়েছিল ১৪০ কোটি ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৫৩ টাকা। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে সাড়ে তিনগুণ মুনাফা কমেছে। যা টাকার অঙ্কে ৯৪ কোটি টাকা।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে অর্থাৎ ক্যাপিটাল গেইন হয়েছে মাত্র ২০৮ কোটি ৬১ লাখ ১৬ হাজার ৪২ টাকা। যা আগের বছর মুনাফা হয়েছিল ৫১২ কোটি ৩১ লাখ ৩৯ হাজার ৪৩৪ টাকা। শেয়ার কেনা-বেচা করতে না পারার কারণে মুনাফা কমেছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই নির্দেশনার কারণে আইসিবির বিনিয়োগ করা অধিকাংশ শেয়ারগুলো আটকে আছে। ফলে এ খাত থেকে অর্ধেক মুনাফা কমেছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা।
সার্বিক বিষয়ে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক জ্বালানি ও পণ্য সংকট হয়েছে। এছাড়াও টাকার মান কমে ডলারের দাম বাড়ায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আর পুঁজিবাজারের অবস্থা ভালো না থাকায় মুনাফা কম হয়েছে।
তিনি বলেন, লাভের জন্য বিনিয়োগ করে মিউচুয়াল ফান্ড এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৭০০ কোটি টাকার বেশি টাকা আটকে আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা পলাতক রয়েছেন। আমরা বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি। মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা উদ্ধারের জন্য একটি মামলা দায়ের করেছি, মালিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও জব্দ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পলাতক এক মালিক ই-মেইলে যোগাযোগ করে জানিয়েছেন তিনি টাকা ফেরত দেবেন। এই সংবাদ বিএসইসিকে জানিয়েছি। আশা করছি, বিনিয়োগ ফেরত পাবে। এসব টাকা ফিরে পেলে আইসিবি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারবে। পাশাপাশি লাভও হবে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আইসিবি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু আইসিবির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থে গ্যাম্লারদের সঙ্গে মিলে সবকিছু লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যাদের আমলে এই কাজগুলো হয়েছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
আইসিবির ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিশ্চিত ৭০০ কোটি টাকা:
আইসিবির তথ্য মতে, আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারি চক্র প্রশান্ত পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের নয়টি প্রতিষ্ঠানে ৬৬৭ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেছে তারা। এরপর মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও মুনাফা তো দূরের কথা আমানতের অর্থই ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
জানা গেছে, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস ২৫ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ১৭ কোটি ৭৯ লাখ ৩৫ হাজার ৭৩৫ টাকা, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ৪৫ কোটি ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪ টাকা, এফএএস ফাইন্যান্সে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩ টাকা, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ৭০ কোটি ৩৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫ টাকা, ফাস্ট ফাইন্যান্সে ১৩৯ কোটি ৬৯ লাখ ৭৪ হাজার ৪৬২ টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসে ১৭৯ কোটি ৫৪ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৩ টাকা, ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ১৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ৬ কোটি ২২ লাখ ৯০ হাজার ৫২২ টাকা বিনিয়োগ করেছিল আইসিবি।
এই অবস্থায় নতুন বছর গণমাধ্যমে খবর এসেছে—অন্তত ১৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছেন ইউনিভার্সাল ফিনান্সিয়ালস সলিউশনের (ইউএফএস) মালিক। এই প্রতিষ্ঠানের তিনটি মিউচুয়াল ফান্ডেও আইসিবির ৪৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।
অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মিউচুয়াল ফান্ড খাতের বিনিয়োগ নিয়ে ৭১৫ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে আইসিবির উদ্বেগ বেড়েছে। পাশাপাশি কীভাবে এটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থার কাছ থেকে আটকে থাকা বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করা যায় সেই পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিএসইসি সূত্র জানায়, ইউএফএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হামজা আলমগীর, এটি পরিচালিত চারটি ওপেন-অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। বিনিয়োগকারীদের তহবিল আত্মসাতের এ ঘটনায় ইউএফএসের সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করায় অডিট ফার্ম আহমেদ জাকের অ্যান্ড কো. লিমিটেডকে পুঁজিবাজার থেকে নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউএফএস পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ডে ২৭ কোটি টাকা, ইউএফএস ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ডে ১ কোটি টাকা এবং ইউএফএস আইবিবিএল-শরিয়াহ ফান্ডে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে আইসিবি।
২০১০ সালে বিএসইসি থেকে লাইসেন্স পেয়েছে ইউএফএস। বর্তমানে পাঁচটি ওপেন-এন্ড ফান্ড পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। আরও দুটি তহবিল অনুমোদন করা হলেও চালু হয়নি। বর্তমানে কোম্পানির দ্বারা পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা।
বিএসইসি চারটি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে- ইউএফএস-পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস-আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস-পদ্মা লাইফ ইসলামিক ইউনিট ফান্ড এবং ইউএফএস-ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড। এই তহবিলের ট্রাস্টি এবং গ্যারান্টার আইসিবি।
এমআই/কেএ