ধাক্কা সামলে অর্থনীতিতে স্বস্তি মিলবে কি?
# এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার ২৩ প্রণোদনা প্যাকেজ
# দুই হাজার ১৭৪ কোটি মার্কিন ডলারের রেকর্ড রেমিট্যান্স
# রিজার্ভ ৪৪.০২ বিলিয়ন
# মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার
# জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ
# করোনায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ
# বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে
অর্থনীতির নানা সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২০ সাল। প্রস্তুতিও ছিল বেশ। কিন্তু তা থমকে দেয় প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। চীনের উহানে প্রথমে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস বছরের শুরুতেই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে। বাংলাদেশে আঘাত হানে কয়েক মাস পর। এরমধ্যে প্রথম দুঃসংবাদটি (করোনা আক্রান্ত শনাক্ত) আসে ২০২০ সালের ৮ মার্চ। আর প্রাণঘাতী ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে ১৮ মার্চ দেশে প্রথম সত্তোরর্ধ্ব একব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন।
মহামারি ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর থেকেই অকল্পনীয় ধাক্কায় ক্ষতির মুখে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। কমতে থাকে আমদানি-রফতানি। বন্ধ হয়ে যায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগে নেমে আসে খরা। বাড়তে থাকে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। দেশের বেশিরভাগ মানুষের কমতে থাকে আয়। সব মিলিয় মহামারিতে অর্থনীতির অবস্থা হয় নড়বড়ে।
সেই ধাক্কা সামলাতে প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেওয়া হয় বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা। তাৎক্ষণিক নেওয়া হয় নানামুখী পদক্ষেপ। এতে করে ক্ষতি কাটিয়ে স্বস্তির পথ খুঁজছে অর্থনীতি। তবে এখনো শঙ্কা কাটেনি। এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারের আরও সহায়তা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা শুধু দেশে নয় পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে। সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে। বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমায় শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতাও কমে গেছে। ফলে আমদানি-রফতানিও কমেছে। কর্মসংস্থান কমে অনেকে বেকার হয়েছে। ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে। এর প্রভাবে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়ে গেছে। তবে লকডাউন তুলে নেওয়ার পর কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে অর্থনীতি। ভ্যাকসিন এলেও এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি।
করোনাকালে রাজস্ব আদায়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকগুলো নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে এরপরও কয়েকটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি ছিল। যেমন- কৃষি খাত আমাদের বেশ ভালো যোগান দিয়েছে। প্রবাসী আয়ও ইতিবাচক রয়েছে। তবে এটা দীর্ঘদিন থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ অনেক প্রবাসী কর্ম হারিয়ে দেশে চলে আসছে বলে জমানো অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যে হারে চলে এসেছে সেই হারে না গেলে ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখা কঠিন হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ
মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজের প্রশংসা করে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, যথাসময়ে সরকারের বিশেষ প্রণোদনার কারণে অর্থনীতি অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে। তবে এসব প্রণোদনা বেশিরভাগ ছিল ব্যাংক নির্ভর। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো প্যাকেজের সুবিধা যেভাবে পেয়েছে সেভাবে ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসায়ীরা পায়নি। তাদের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিক দিক মিলিয়ে বলতে গেলে- সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ের উৎস বাড়াতে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে আগামীতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিশেষ প্রণোদনা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি টিকে থাকতে ছোট বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি নীতি সহায়তা দিতে হবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা আমাদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। এ পরিস্থিতির বিষয়ে আগে কোনোসময় কল্পনাও করিনি। তারপরও ব্যাংকের মুনাফায় খুব বেশি আঘাত লাগেনি। তবে শঙ্কার বিষয় ঋণ বিতরণ কমেছে। আমানত আসছে কিন্তু ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না। ঋণ না দিতে পারলে লাভ আসবে না। বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতিও খুব ভালো না। অনেক দেশে করোনা পরিস্থিতি নতুন রূপ নিয়েছে। রফতানি বাজারও ইতিবাচক নয়। বড় চ্যালেঞ্জের মুখে আছি। আগামীতে কী ঘটবে তা জানি না। এসবে মধ্যেই আমরা চলছি।
লকডাউন
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। নিত্যপণ্য ছাড়া সব দোকানপাট-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ধাপে ধাপে সেই লকডাউনের সময় বাড়তে থাকে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে সীমিতভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া শুরু হয়। টানা ৬৬ দিন বন্ধের পর ২০২০ সালের ৩১ মে স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে খুলে দেওয়া হয় দেশের সব সরকারি-বেসরকারি অফিস।
রফতানিতে করোনার আঘাত
করোনায় ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত এবং কারখানা বন্ধ থাকায় এপ্রিলে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়। শেষ পর্যন্ত গত অর্থবছর ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আগের বছরের চেয়ে ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ কম। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের রফতানি আয় কমেছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৪ শতাংশের মত।
সরকারের বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ
কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গত ২৫ মার্চ পাঁচ হাজার কোটি, ৫ এপ্রিল ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পরে আরও মিলিয়ে ২৩টি প্যাকেজে মোট ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার।
রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন
দেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক যখন খারাপ অবস্থা তখন আশার আলো দেখাচ্ছে প্রবাসী আয়। মহামারি সংকটের মধ্যেও বেড়েছে রেমিট্যান্স। ২০২০ সালে বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২ হাজার ১৭৪ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ৮২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি; (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে)। যা ইতিহাসে একক বছরে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছিল ২০১৯ সালে, এক হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার।
রিজার্ভের রেকর্ড
প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও আমদানি কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নতুন নতুন উচ্চতা ছুঁয়ে গেছে। করোনার মধ্যে রিজার্ভ ৪৪.০২ বিলিয়ন বা চার হাজার ৪০২ কোটি ডলার পৌঁছায়।
মাথাপিছু আয়
মাথাপিছু আয় প্রথমবারের মতো দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছর শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। গত এক দশকে মাথাপিছু আয় আড়াই গুণ হয়েছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে
করোনার কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে পতন হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।
রাজস্ব আদায়ে ধস
করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দার কারণে রাজস্ব আদায় কমেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) রাজস্ব আয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), টাকার অংকে যা প্রায় ৩৩ হাজার কোটি। আলোচ্য সময়ে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ২২৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৪৭১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
দেড় কোটি নতুন দরিদ্র
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাব অনুযায়ী, করোনায় নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসামীর নিচে নেমে গেছে।
কপাল খুলেছে ঋণ খেলাপিদের
করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে নতুন করে ঋণ খেলাপি হবে না বলে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ঋণ শোধ না করেও খেলাপি হননি অনেক ব্যবসায়ী। আবার নতুন করে ঋণও পেয়েছেন। ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি বা মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ। খেলাপির ঋণের এ পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ হাজার ৪৮ কোটি টাকা কম।
মহামারিতেও সচল ছিল ব্যাংক
করোনাভাইরাসের কারণে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তবে এ সময়ে খোলা ছিল ব্যাংক। করোনায় গ্রাহকদের সেবা দিতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞার মুখোমুখি হন ব্যাংকাররা। আক্রান্ত হয়ে মারা যান অনেক ব্যাংকার।
৬৬ দিন বন্ধ ছিল শেয়ারবাজার
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে শেয়ারবাজারে লেনদেনও বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন লেনদেন বন্ধ ছিল।
ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর
মহামারির মধ্যেও ব্যাংকের ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন শুরু হয়। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ব্যাংকের সব ঋণের জন্য ৯ শতাংশ সুদহার ১ এপ্রিল থেকেই কার্যকর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেসরকারি ঋণে কম গতি
বিনিয়োগ বাড়াতে কমানো হয়েছে ঋণের সুদহার। দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। রয়েছে মহামারির ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সুরক্ষায় প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ। কিন্তু তারপরও আশানুরূপ বাড়ছে না বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ। ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
এফডিআই কমেছে ৮ শতাংশ
মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার প্রভাব সরাসরি পড়েছে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ওপর। গত অর্থছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১৬৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশে। এই অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে ১৫৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
এসআই/এসএম