অনিয়মে বন্ধ ইউকে শাখা, নতুন ২ প্রতিষ্ঠান গড়তে চায় সোনালী ব্যাংক
অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থপাচার প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে সোনালী ব্যাংক যুক্তরাজ্য শাখা বন্ধ করে দেয় ইউকে কর্তৃপক্ষ। সেই শাখার কার্যক্রম আবারও চালু করতে চায় সোনালী ব্যাংক। তবে তা ভিন্ন উপায়ে। আলাদা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সেখানে দুটি নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়তে চায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। ওই দুই প্রতিষ্ঠান থাকবে সোনালী ব্যাংকের মালিকানায়।
প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— সোনালী বাংলাদেশ (ইউকে) লিমিটেড ও সোনালী পে (ইউকে) লিমিটেড। বন্ধ হয়ে যাওয়া সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখার রক্ষিত আমানত থেকে এই প্রতিষ্ঠান দুটির পরিশোধিত মূলধন জোগান দেওয়া হবে।
সোনালী ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, গত ৩১ আগস্ট অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ৭৮৭তম পর্ষদ সভায় নতুন প্রতিষ্ঠান দুটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যাংকের শতভাগ মালিকানায় গঠন করা হবে সোনালী পে (ইউকে) লিমিটেড। যার পরিশোধিত মূলধন বাবদ এক মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড (১২ কোটি টাকা) দেওয়া হবে বন্ধ হয়ে যাওয়া সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের রক্ষিত আমানত থেকে।
আরও পড়ুন : খেলাপিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ব্যাংক, ছাড়াল এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা
পরিশোধিত মূলধন ইতোমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে বলে গত ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ৭৮৮তম পর্ষদ সভায় জানানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাজ্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহের স্বার্থে এক মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড পরিশোধিত মূলধন নিয়ে অথোরাইজড পেমেন্ট ইনস্টিটিউশন হিসেবে গঠন করা হবে সোনালী পে ইউকে লিমিটেড। অথোরাইজড পেমেন্ট ইনস্টিটিউশন হিসেবে অনুমোদনের জন্য স্থানীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি অব ব্যাংক ইংল্যান্ড থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. আফজাল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নতুন করে প্রতিষ্ঠান দুটি গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি অনুমোদনের জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছি। তারা বেশ কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে তা দেওয়া হচ্ছে।’
নানা অনিয়ম ও অবহেলার কারণে সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখা বন্ধ হয়েছে। তাহলে আবার নতুন করে চালুর সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো? এ প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী আফজাল করিম জানান, ‘বন্ধ যখন হয়েছে তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। ওই সময় যারা ছিলেন তারা ভালো বলতে পারবেন। আর কীভাবে পরিচালনা করা হবে বা অর্থসংস্থান হবে, সেসব বিষয় অনুমোদনের পর বলতে পারব।’
নতুন প্রতিষ্ঠান খোলার আগে অনিয়মের তদন্ত জরুরি
আগের অনিয়ম-দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি হলে নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করে লাভ হবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আরও পড়ুন : রিজার্ভ নামবে ২৬ বিলিয়ন ডলারে !
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের ইউকে শাখা ভালোই চলছিল, লাভজনকও ছিল। তাহলে প্রতিষ্ঠানটি কেন বন্ধ করতে হলো আগে এটি তদন্ত করতে হবে। যেসব কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আগের সেই অব্যবস্থাপনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।’
১৯৯৯ সালে শুরু, ২০২২-এ শেষ
প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সেবা দিতে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্যে কার্যক্রম শুরু করে সোনালী ট্রেড অ্যান্ড ফাইন্যান্স। পরে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের লাইসেন্স নিয়ে ২০০১ সালে তা ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। প্রবাসী আয়ের সঙ্গে ঋণপত্রের নিশ্চয়তা দেওয়া শুরু করে তারা। পাশাপাশি আমানত সংগ্রহ ও ঋণ কার্যক্রম চালু করা হয়।
ব্যাংকটির মালিকানার ৫১ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের হাতে। আর ৪৯ শতাংশ সোনালী ব্যাংকের হাতে। কয়েক দফায় দেশ থেকে মূলধন জোগান দেওয়া হয় শাখাটিতে। এখন সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের মূলধনের পরিমাণ ৬ কোটি ৩৮ লাখ পাউন্ড। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৬ কোটি ডলার ঋণও দেওয়া হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত বন্ধ করার নির্দেশনায় যুক্তরাজ্যের মাটিতে বাংলাদেশের সব বিনিয়োগ জলে গেল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (পিআরএ)’ এবং ‘ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)’ গত ১৬ আগস্ট শাখাটির কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই প্রতিষ্ঠার ২১ বছরের মাথায় এটি বন্ধ হয়ে যায়।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে শাস্তি নয়, পুরস্কার
সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখার নানা অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তখনকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আতাউর রহমান প্রধান। ‘ইউকে শাখার করণীয়’ বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, ‘২০১৬ সালে নন-কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ব্যাংকের পাশাপাশি তৎকালীন সিইও মো. আতাউর রহমান প্রধানকে দায়িত্বে অবহেলা, সুপারভাইজরি ঘাটতি ও অন্যান্য কারণে ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানা করে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড। ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর তা এফসিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।’
এ অনিয়মের জন্য কোনো শাস্তি পাননি আতাউর রহমান প্রধান। উল্টো তাকে পুরস্কৃত করা হয়। তিনি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান।
এসআই/কেএ