মামলাজটে দেড় লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ
অনেক গ্রাহকই ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, ফেরত দেন না। আবার বিভিন্ন পক্ষের মাধ্যমে যোগসাজশে দেওয়া ঋণ আদায় হচ্ছে না। বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার পরও ঋণের অর্থ পরিশোধে চলে নানা টালবাহানা। এমন ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংক আইনি লড়াইয়ে নামে। হতে থাকে একের পর এক মামলা। আর এসব মামলা নিষ্পত্তিতে চলছে দীর্ঘসূত্রতা। বছরের পর বছর মামলায় আটকে আছে খেলাপি ঋণের লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের করা মামলার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৩৬৯টি। এর বিপরীতে ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর পাওনা এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বর শেষে অর্থঋণ আদালতে মামলার স্থিতি ছিল ৬৮ হাজার ২৭১টি। এর বিপরীতে দাবির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলার সংখ্যা বেড়েছে এক হাজার ৯৮টি। একই সময়ে ব্যাংকের দাবি করা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৯ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। ফলে মামলার মাধ্যমে অর্থ আদায় করা সময়সাপেক্ষ। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিবাদী পক্ষ উচ্চ আদালতে রিট করে মামলা ঝুলিয়ে রাখে। এসব সমস্যা সমাধানে ২০০৩ সালের অর্থঋণ আদালত আইন এবং ১৯৯৭ সালের দেউলিয়া আইন সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে আইন দুটি যুগোপযোগী করার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, মামলা নেওয়ার পর সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। উপযুক্ত কারণে নির্ধারিত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে না পারলে সর্বোচ্চ আরও ৩০ দিন সময় বাড়ানো যাবে। সেই সংশোধনের প্রস্তাবও আটকে আছে চার বছর।
মামলাজটে আটকে থাকা খেলাপি ঋণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপিদের বড় অংশই প্রভাবশালী। তারা বিভিন্ন অনিয়ম করে ঋণ নেন। অনেক সময় ব্যাংকগুলোত কাছে এসব ঋণের পর্যাপ্ত জামানতও থাকে না। ফলে তারা যখন ঋণ ফেরত দেন না, তখন ব্যাংক মামলা করেও তেমন সুবিধা করতে পারে না।
তিনি বলেন, একটি মামলা হলে সেটি বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, নিষ্পত্তি হয় না। অনেক সময় আদালতে রিট করে মামলা স্থগিত করে রাখা হয়। এ ছাড়া আইনের ফাঁক-ফোকরে অনেক খেলাপি পার পেয়ে যান। তাই খেলাপিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে আইন সংশোধন জরুরি। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। তা না হলে মামলা করেও খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব নয়।
খেলাপি ঋণ কত?
খেলাপি ঋণ কমাতে ঢালাও সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনার কারণে গেল বছরও ঋণ পরিশোধে ছাড় ছিল। এ ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ নানান ছাড়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার অনেক গ্রাহকের আবেদনে উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি না দেখানোর ওপর আদেশ দেওয়া হচ্ছে।
এ সব কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ রয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো। ফলে আসলে কত টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে অনেক বিশ্লেষকই বলেন, ব্যাংক খাতের সঠিক হিসাব করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এসআই/আরএইচ