লাগামহীন খেলাপি, কচ্ছপ গতিতে আদায়
অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবে দেওয়া ঋণ আদায় হচ্ছে না। লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তবে আদায় হচ্ছে কচ্ছপের গতিতে। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ শতাংশ। এর বিপরীতে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমাদের দেশে খেলাপিদের তেমন কোনো দৃশ্যমান শাস্তি দেওয়া হয় না। উল্টো খেলাপিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে চায় না। আবার অনেকে সস্তায় ঋণ নিয়ে অর্থপাচার করে। আবার কেউ এক খাতে ঋণ নিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত। এভাবে চলতে থাকলে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। যা গত মার্চ প্রান্তিকে ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আদায় না হওয়া মন্দ ও পুনঃতফসিল করা ঋণ নতুন করে যুক্ত হওয়ায় নতুন খেলাপি ঋণ হয়েছে ১৫ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এ জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সবসময় বলি ঋণ খেলাপিদের একের পর এক ছাড় বা সুবিধা দিলে তারা টাকা ফেরত দেবে না। তারা সুবিধা পেলে আরও পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবে। কারণ তারা দেখছে ঋণ ফেরত না দিলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আর শাস্তি না পেলে টাকা দেবেও না।
আরও পড়ুন : খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা
তিনি জানান, এক খাতে ঋণ নিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করছে। প্রণোদনার ঋণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে, কোনো শাস্তি পাচ্ছে না। করোনার প্রভাব এখন আগের মতো নেই। তবুও টাকা দিচ্ছে না। কিন্তু কেন? এটাই প্রমাণ করে যতই সুযোগ দেবেন টাকা ফেরত পাবেন না।
তাই আমি বলবে খেলাপি কমাতে হলে যেকোনো মূল্যে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। আর যারা ঋণ পরিশোধ করছে না তাদের কঠোর দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই বলে জানান সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা।
ব্যাংকগুলোতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। যা গত মার্চ প্রান্তিকে ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকায়। ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণস্থিতির যা ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। গত ৬ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো। মামলাসহ বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেও এসব খেলাপি ঋণ আশানুরূপভাবে আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকাররা জানান, কঠোরতার চেয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর উপায় হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ছাড় দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালে কেউ কোনো টাকা না দিলেও তাকে খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে একজন উদ্যোক্তার যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, কেউ ১৫ শতাংশ দিলে তাকে আর খেলাপি করা হয়নি। এর আগে ২০১৯ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য বিপুল পরিমাণের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এরও আগে ৫০০ কোটি টাকার বড় অংকের ঋণ পুনর্গঠন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন শিথিলতা দেওয়া হয়। বারবার এ রকম শিথিলতার কারণে উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ঋণ পরিশোধের চেয়ে সুবিধা নেওয়ার পেছনে ছুটছেন বেশি। আর এসব ছাড়ের কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না।
বিভিন্ন অংকের ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ব্যাংকগুলো আগে থেকেই ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারত। তবে নিয়ম মেনে নির্ধারিত হারে ডাউনপেমেন্ট দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ পুনঃতফসিল কম হয়েছে। বেশিরভাগ ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদনে। এমন প্রেক্ষাপটে ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালায় ব্যাপক শিথিলতা এনে এখন পুরো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ১৮ জুলাই জারি করা নীতিমালার আওতায় বড় অংকের একটি মেয়াদি ঋণ চার দফায় পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সব পর্যায়ে ডাউনপেমেন্টের হারও কয়েক গুণ কমানো হয়েছে। আবার পুনঃতফসিলের পর নতুন ঋণ নেওয়ার জন্য যে কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট দিতে হয় সেটার পরিমাণও কমানো হয়েছে অনেক।
এসআই/এসএসএইচ