ডিমে লুটপাট নয়, মুনাফা করেছেন ব্যবসায়ীরা : প্রতিমন্ত্রী
মুরগি ও ডিমের দাম বাড়িয়ে প্রায় ৫২০ কোটি টাকা লুটপাট— পত্র-পত্রিকায় এমন খবরের সমালোচনা করে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, এটি লুটপাট নয়, ডিম ব্যবসায়ীরা মুনাফা করেছেন। যারা এসব কথা বলছেন বা লিখছেন, তারা বাজার ব্যবস্থাপনা না বুঝেই করছেন।
রোববার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সভায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা, ব্যবসার বিধি-বিধানসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়।
প্রধান অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম দেশের অর্থনীতিবিদদের ‘আশঙ্কাবাদী’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতির অর্জন ও সম্ভাবনা দেখতে পান না। কিন্তু বিদেশি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তি ও সম্ভাবনা তুলে ধরছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক বেকার যুবক ডিমের ব্যবসা শুরু করেছেন। এমন সম্ভাবনাময় খাত নিয়ে কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনা না বুঝেই ক্রাইম করছি। ওই অনেকটা অর্থনীতিবিদদের মতো আমাদের সাংবাদিকরাও আশঙ্কায় থাকেন। ৫২০ কোটি টাকা লুটপাট করেছে, এটি ঠিক নয়। বাজার অর্থনীতি না বুঝেই এটি লিখছেন। এটিকে লুটপাট বলা যাবে না, তারা লাভ করেছেন।’
দেশের অর্থনীতিবিদদের কড়া সমালোচনা করে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘অর্থনীতিবিদরা অনেক কিছু নিয়ে আশঙ্কা করেন। কিন্তু আমরা অর্থনীতিবিদদের এ আশঙ্কাকে এখন খুব একটা গুরুতরভাবে নিই না। কারণ আমরা যখন অষ্টম-সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করি তখন একজন সম্মানজনক অর্থনীতিবিদ লিখেছিলেন, যেভাবে সরকার বাজার খোলা রাখতে চাচ্ছে, লকডাউন দিচ্ছে না, এতে করে ৫ লাখ লোক মারা যাবে। আমাদের অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, পদ্মা সেতু করা মানে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নামিয়ে আনা, কারণ মেগা প্রজেক্টগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। আসলে বন্ধ হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিবিদরা কোনো সময় পূর্বাভাস দেননি যে, বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। কোনো অর্থনীতিবিদ বলেন না বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। অনেকে বলেছেন, কোভিড কালে বাংলাদেশের দারিদ্র্য ৩৩ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু বিআইডিএসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ দারিদ্র্য বেড়েছে। যে দেশে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, সেই দেশে দারিদ্র্য এত বাড়ে কীভাবে?
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিবিদরা জ্ঞানে বুদ্ধিতে অনেক এগিয়ে। কিন্তু প্রথাগত ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আশঙ্কা করার ক্ষেত্রে খুব দক্ষ। তাই তারা পদ্মা সেতু নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তারা অনেক কিছুই আশঙ্কা করেন। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। তাদের এ আশঙ্কা যদি আমরা আমলে নিই, তাহলে সামনে এগিয়ে যেতে পারব না।’
শামসুল আলম বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে ইন্ধন দিচ্ছে। এ কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, কথা সত্য। দাম না বাড়িয়ে বিকল্প ছিল না। তবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, অক্টোবরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে। পরিকল্পনায় কোনো দুর্বলতা নেই। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ অস্বস্তিতে আছে, কোনো সংকটে নেই। এলডিসি থেকে উত্তরণ, এসডিজি বাস্তবায়ন সবই ঠিকভাবে হবে। তবে দারিদ্র্য পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে উন্নতমানের কয়লা মজুত আছে। এক সময় কথা উঠেছিল, উন্নতমানের কয়লা থাকতে আমদানি করা হচ্ছে। সেটা করা হয়েছে দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ার কারণে। কখনো কখনো অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দিতে হয়। কয়লা উত্তোলনে কৃষি জমি দেবে যেতে পারে, ধসে যেতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে আমাদের জমির স্বল্পতা আছে, সেখানে এ ধরনের আশঙ্কা থাকলে সেটা করা ঠিক না। অনেক দেশে কয়লার খনি এলাকা লেক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি। এজন্যই কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কাজ করছে না। সামনে আরও দুঃসময় আসছে। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে ঠেকতে পারে। লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি সহসাই কমবে না। যদিও আগামীতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়বে। আমদানি কিছুটা কমে আসবে। বৈদেশিক লেনদেনে যে ভারসাম্য দরকার তা মোটামুটিভাবে হবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু করা হয়নি। সরকার সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কিন্তু চালের উৎপাদন কম হয়েছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমনের চাষও ভালো হওয়ার আশা করা যাচ্ছে না। চালের দাম বাড়বে। বাজারকে দোষ দিলে হবে না। চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও প্রয়োজনীয় আমদানি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সরকার বাজেট ব্যবস্থাপনায় ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এরপরও বাজেট বাস্তবায়নে বিদেশ থেকে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আনতে হবে। দেশের ব্যাংক থেকেও এক লাখ কোটি টাকার বেশি নিতে হবে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজস্ব ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার দরকার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে। তবে এ মূল্যস্ফীতি পুরোটাই আমদানিজনিত। এরপরও বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য সুদহার না বাড়িয়ে সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ডলারের বিনিময় হার শিগগির কমে আসবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নতি হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে আছে।’
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, ‘রপ্তানি আদেশ কমছে। বড় বড় কারখানা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি খরচের সমন্বিত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে সরকার যে প্রণোদনার ঋণ পরিশোধে কম সময় দিয়েছে, তাতে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বন্ড লাইসেন্স, এইচএসকোডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এনবিআরের পলিসি ব্যবসায়ী পরিপন্থী। আইন দ্বারা ব্যবসায়ীদের ওপর জলুম, নির্যাতনের ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। যতই চ্যালেঞ্জ আসুক বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে থাকবে।’
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, ‘দেশে কয়লার যথেষ্ট মজুত রয়েছে। নিজস্ব যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। জ্বালানিতে আমদানি নির্ভরতা এমন পর্যায়ে গেছে যে, এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনায় কিছু দুর্বলতা রয়েছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে না উঠলে ভবিষ্যৎ খারাপ হবে। প্রতিযোগিতামূলক থাকা এখন প্রথম চ্যালেঞ্জ। এছাড়া নীতি-নির্ধারণী পদ্ধতির কারণে ব্যবসায় নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এটাও বড় চ্যালেঞ্জ। চাল, মাছ, মুরগির দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসছে, তা সমন্বয় করতে হবে।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা খুবই জরুরি। অবশ্যই জ্বালানিতে বিপ্লব হয়েছে। দেশের অর্থনীতি যে গতি পেয়েছে, সেখানে জ্বালানির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এখনকার জ্বালানি আমদানি-নির্ভর। এ বিষয়টি পুনরায় চিন্তা করার সময় এসেছে। দেশে যে কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহার করতে হবে, এজন্য মাস্টারপ্ল্যান করা উচিত, যাতে দেশ আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে মধ্যে জ্বালানি স্বনির্ভর হয়।’
রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিনভী। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা যদি সফলতার তথ্যই প্রচার করেন, অসঙ্গতি তুলে না ধরেন, তাহলে দেশের উন্নয়ন হবে না। কারণ সরকার মনে করবে আমাদের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে তারা আত্মতুষ্টিতে ভুগবে। অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা ও সংবাদপত্রের লিখনি দেশের উন্নয়নে ভুল ত্রুটি সংস্কার ও সংশোধনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’
ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চায়লনায় সংগঠনের সিনিয়র সদস্যরা চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতামত তুলে ধরেন।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার জানান, কয়েকদিন ধরেই বাজারে ব্রয়লার মুরগির পাশাপাশি ডিমের দামে বেশ অস্থিরতা চলছে। একটি মাফিয়া চক্র গত ১৫ দিনে ডিম ও মুরগির বাজার থেকে ৫১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এসআই/আরএইচ