গরিবের ‘গরুর মাংস’ ব্রয়লারেও কেজিতে বেড়েছে ৪০ টাকা
মো. শাহজাহান, একটি ফার্নিচার দোকানে কাজ করেন। ১২ জন মিলে একটি মেসে থাকেন। মেসের আমিষের বাজারের তালিকায় আজ মুরগি। তাই মেসের আরেক সদস্য কামরুল ইসলামকে নিয়ে বাজারে এসেছেন শাহজাহান। দুই কেজি মুরগির জন্য তাদের বরাদ্দ ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। কিন্তু দোকানে এসে মুরগির দাম শুনে তাদের চোখ কপালে।
শাহজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি সাধারণ মানুষ। ফার্নিচার দোকানে কাজ করি। সঙ্গে ‘ভাই ভাই মেস’ পরিচালনা করি। সেখানে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ জন খাই। আজ মুরগি কিনতে এসেছি। হিসাব অনুযায়ী, তিন কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনতে ৩৫০ টাকা যথেষ্ট, কিন্তু সেখানে ১০০-১৫০ টাকা বাড়তি লাগছে। ব্রয়লার কিনতেই যদি এমন হয়, তাহলে বাকি বাজার কীভাবে করব!
তিনি বলেন, গত সপ্তাহেও ব্রয়লার মুরগি কিনেছি ১৬০ টাকায়। আর আজ চাচ্ছে ২০০-২২০ টাকা। মরিচ-পেয়াজসহ সব পণ্যের দাম বাড়তি। ডিমের কথা আর কী বলব। বাস বলেন আর রিকশা, উঠতে গেলেই বাড়তি ভাড়া।
নিজের ক্ষোভ আর হতাশা উগড়ে দিয়ে শাহজাহান বলেন, আমি দিন আনি, দিন খাই। দিনে ৫০০ টাকা মজুরি পাই। বাজারের অবস্থার সঙ্গে আমার আয়ের কোনো মিল নেই। আমার হাজিরা বাড়েনি। মজুরি আগে যা ছিল, তাই আছে। তাহলে আমরা সাধারণ মানুষরা কোথায় যাব? সরকারি চাকরিজীবীদের সমস্যা নেই। মজুরি বাড়ানোর কথা বললে মহাজন উত্তর দেন, ‘দাম কিছু শুধু তোমাদের জন্য বাড়ছে, আমার জন্যও বাড়ছে! আমার কথা তাহলে কে শুনবে?’
শুধু শাহজাহান একাই না, রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার অলি মিয়ারটেক বউ বাজারে মুরগির দোকানে আসা অধিকাংশ ক্রেতারই একই বক্তব্য।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা বেড়েছে। বর্তমান দাম ২০০ টাকা। শুধু ব্রয়লার নয়, বেড়েছে পাকিস্তানি কক মুরগির দামও। গত সপ্তাহেও পাকিস্তানি ককের দাম ছিল ২৪৫-২৫০ টাকার মধ্যেই। আজ বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৭৫ টাকায়।
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। মধ্যবিত্তের জন্য কোনো জায়গা থাকছে না। নিম্নবিত্তরা আরও নিচে ধাবিত হচ্ছেন। সবকিছু ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।
বউ বাজারের পাশেই একটি হোটেল রয়েছে খোকন শেখের। মুরগি কিনতে এসে তিনি অবাক। বাড়তি দাম শুনে গড় গড় করে বলছিলেন, ‘ব্যবসা বুঝি ছাড়তে হবে’।
নিজের হতাশার কথা উল্লেখ করে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ ব্রয়লার ২০০, কক ২৭০/২৮০ টাকা কেজি। আগে যখন ১৫০ টাকায় ব্রয়লার কিনেও হোটেলে পোষাতো না। এখন কীভাবে পোষাবে? লাভ কী থাকবে? কেজিতেই তো ৪০ টাকা নাই। ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ। পথে নামতে হবে এমন দশা। হয় আমাকে হোটেল ব্যবসা ছাড়তে হবে, নয়তো সিস্টেমে চলতে হবে।
কীভাবে চলবেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে দেড় কেজির ব্রয়লার মুরগি ১২ পিস করে ৬০ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন তো ওই দামে বিক্রি করতে পারব না। আবার দাম বাড়ালেও বেচা-বিক্রি লাটে উঠবে। তাই পিস ছোট করে ১২ পিসকে ২৪ পিস বানাবো। দাম কমিয়ে ৬০ টাকার জায়গায় ৪০ টাকায় বিক্রি করে পুষিয়ে নিতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় নাই।
পাশেই গরুর মাংস বিক্রি করছিলেন আক্কাস আলী কসাই। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ত্যালের (তেল) ধাক্কা সবখানে। পিকআপ, গাড়ির ভাড়া বাড়ছে। তাই গরু কিনতেও বাড়তি টাকা লাগতাছে। কেজিতে আমার কেনা পড়তাছে ৫৮০ টাকা। দোকান খরচাসহ ৬৮০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি কইরাও পোষাইতাছে না। কিন্তু বাড়ায় দিলেও বিক্রি হবে না। এমনিতেই বেচা-কেনা কম।
স্ত্রীকে নিয়ে মাংসের দোকানে ঘুরছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আলাউদ্দিন। গরুর মাংসের দোকান ঘুরে মুরগির মাংসের দোকানে দাঁড়িয়েও ভাবছেন।
তিনি বলেন, বাসায় মেহমান এসেছে। এক কেজি গরুর মাংস কিনতে গেলে ৭০০ টাকা লাগে। সেটা তো আর কিনতে পারব না। তাই ব্রয়লার কিনতে এসেছি। কিন্তু দেখেন, ব্রয়লারেও আগুন লেগেছে! ২০০ টাকা কেজি। কেজিতে ৪০/৫০ টাকা বেড়েছে। আমরা গরিব মানুষ, ন্যায্যমূল্যে কিছুই পাচ্ছি না। সবকিছুর দাম বাড়তি। আমার ১৬ হাজারের চাকরিতে অসহায় লাগছে।
মুরগি ব্যবসায়ী রাকিবও ক্রেতাদের অসহায়ত্বে নিজের মন খারাপের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘দিন শেষে ভাই আমিও ক্রেতা। বাড়তি দাম কইতে আমারও খুব খারাপ লাগতাছে। এক সপ্তাহ আগে চাইলাম ১৫০ টাকা কেজি, আজ সেই ব্রয়লার ২০০! আমরা সবাই জিম্মি। ন্যায্যমূল্যটা আমরা কেউ পাইতেছি না। কেউ দেখার নাই। সাধারণ মানুষের ভাষা নাই, গরিবরা মরতাছে। ভালো লাগলে কিন্না খান, নইলে দরজা আটকাইয়া বউ-বাচ্চা নিয়া বইসা থাকেন, অবস্থাটা সেরকমই যাইতাছে।’
বাড়তি দামের কারণে মুরগি কম কিনছেন উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘যখন মার্কেটে যাই, কয় কেজি মাল কিনব সেই হিসাবে করে টাকা নিয়া যাই। কিন্তু রেটের অবস্থা বাড়তি। জিগাইলে কয় গাড়ি ভাড়া ডাবল। আমিও ক্রেতা। কিনে এনে বিক্রি করি। আগে পরিমাণে বেশি কিনতাম, এখন বাড়তি দামের কারণে কম কিনতাছি।’
জেইউ/এমএইচএস