জ্বালানির মুনাফার টাকা কোথায় গেল, জানাল বিপিসি
দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আয়-ব্যয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। জানা গেছে গত ৭ বছরে বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো কেন? পূর্বের আয় থেকে ভর্তুকি দিলেই তো আপাতত চলত। আজ (বুধবার) সকালে সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রশ্ন তুলেছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডিও।
এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে আজ বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে বিপিসি। এতে সংস্থাটির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ দাবি করেন, ৭ বছরের যে মুনাফার কথা বলা হচ্ছে তা এর আগের ১৪ বছরের লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত জ্বালানি খাতে ক্রমাগত লোকসান গুনতে হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার ৫ কোটি টাকার মতো। এ খাতে ভর্তুকির বিনিময়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে ৪৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকার মতো বিপিসিকে প্রদান করে। ওই সময়ে আরও প্রায় ৮ হাজার ১২৭ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল, যা পরে বিপিসির মুনাফার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতি লিটার ডিজেলে ১২০ টাকা খরচ হচ্ছে বিপিসির। এ ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ৬ টাকার মতো লোকসান দিতে হচ্ছে। তবে অকটেনে ২৫ টাকার মতো লাভ হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। ক্রুডের ওপর পেট্রোল ও অকটেনের দাম নির্ভর করে। পেট্রোল ও অকটেনের দাম কৌশলগত কারণে বাড়াতে হয়েছে।
এ বি এম আজাদ বলেন, আপনারা জানেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত সেটি বহাল আছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের প্রতি ব্যারেল কেনার খরচ পড়ত প্রতি ডলারে ৯৬ দশমিক ৯৫ ডলার। প্রতি লিটারে আমরা যখন এটাকে কস্টিং করি, প্রতি লিটার পড়ে ৮৩ টাকা ৬ পয়সা। ওই সময়ে বিপিসি বিক্রয় করতো ৮০ টাকা করে। সেখানে লিটারে ৩ টাকার মতো লোকসান ছিল।
তিনি বলেন, আবার ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন প্রতি ব্যারেল ১০৮ ডলার ৫৫ সেন্ট, সেটাকে টাকায় প্রতি লিটারে কনভার্ট করলে হয় ৮৯ টাকা ৮৫ পয়সা। তখনও বিপিসি বিক্রি করেছে ৮০ টাকা লিটার। যে কারণে ওই মাসে ৯ টাকার মতো লোকসান গুনতে হয়েছে। এ ফর্মুলায় গত জুলাই মাসে প্রতি ব্যারেল মূল্য ছিল ১৩৯ দশমিক ৪৩ ডলার, টাকায় প্রতি লিটারে কনভার্ট করলে খরচ পড়ত ১২২ টাকা ১৩ পয়সা। তখনও ওই তেল বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। এভাবে তেলের দাম বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে প্রতি লিটারে লোকসান এসে দাঁড়িয়েছিল ৪২ টাকা ১৩ পয়সা।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, এ পরিস্থিতিতে বিপিসির গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসির প্রকৃত লোকসান ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বিপিসি বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। নতুন করে ১১টি প্রকল্প হাতে রয়েছে, যার খরচ প্রায় ৩৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকার বেশি। ইআরএল ইউনিট-টু, যার খরচ ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে বিপিসির মুনাফার একটি অংশ এফডিআর করা হয়। আপনারা জানেন, বিপিসির অর্থ কোনো না কোনো ব্যাংকের হিসাবের বিপরীতে রাখতে হয়। প্রকল্পের যে অর্থ, সেগুলো প্রকল্পের নামে এফডিআর খুলে রাখা হয়। সরকারের কাছ থেকে কোনো ভর্তুকি না নিয়ে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা থেকে গত ৬ মাসের জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
এদিকে আজ এক সংলাপে বিপিসির আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়েছে গবেষণা সংস্থা সিপিডি। সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত ৭ বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? বলা হয়েছে, ওই টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা কোনটা লাভ, কোনটা লোকসান বলছে সেটা জানা প্রয়োজন।
বিপিসির আয়ের অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় করা প্রসঙ্গে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সূত্রে যে খতিয়ান দেখতে পাই, তাতে নিজস্ব অর্থায়নে ১১টি প্রকল্পের তথ্য পেয়েছি। সেখানে ব্যয় হবে ৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে মাত্র ৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ আছে। তাহলে বিপিসির টাকা কোথায়? আমরা জানতে পেরেছি বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে। তাহলে ওই টাকা কোন টাকা? এছাড়া বাকি টাকা কোথায়? আমার ধারণা বাকি টাকাও বিপিসির হিসাবেই রয়েছে। তাহলে কেন লোকসান দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো?
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরেও ৫ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বিপিসি। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, এ বছরেও বিপিসি বিনিয়োগ করবে! জনগণের মাথায় বোঝা চাপিয়ে বিপিসি কোথায় বিনিয়োগ করবে?
এসকেডি