পিছিয়ে পড়াদের প্রতি অন্যায্য আচরণ হয়েছে
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি অন্যায্য আচরণ করা হয়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, বাজেটে তা বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে ভর্তুকি বাড়ানো দরকার।
রোববার (১৯ জুন) ব্র্যাক সেন্টারে ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩ : পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী আছে’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যসহ বিভিন্ন বক্তাদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে আসে।
আলোচনায় অতিমারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সামনে রেখে এবারের বাজেটকে অনেকেই বলছেন সম্ভাবনাময় ও চ্যালেঞ্জিং। অনেকে ব্যবসা বান্ধব, প্রশাসন বান্ধব ও অনৈতিকতাকে বৈধতা দেওয়ার বাজেটও বলেছেন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনায় বলেন, তিনটি মূল বিষয়ের প্রতিফলন বাজেটে থাকতে হবে। প্রথমত, অতিমারির প্রভাব স্বাস্থ্যগতভাবে আমরা পার করে এলেও এর আর্থ সামাজিক যে প্রভাব নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ওপর পড়েছে, তা আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, গত ১০-১৫ বছরে সামষ্টিক অর্থনীতি এরকম চাপে পড়েনি। তৃতীয়ত, বিশ্বে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এ তিনটি বিষয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব কিছু মোকাবিলা করার জন্য অনেক চিন্তা, দক্ষতা এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করার জন্য মূল্যস্ফীতিকে মূল সূচক হিসেবে ধরতে হবে, এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দ্বৈত বিনিময় হার এবং সুদের হারে সমতা আনতে হবে। এর পাশাপাশি বাজেটে কৃষি খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। টিসিবিকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। সাধারণত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক অভিঘাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের আয় দ্রব্যমূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে বাড়ে না। আগামী অর্থবছরে তাদের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, তা বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে ভর্তুকি বাড়ানোর সুযোগ রাখতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বেশি হতে হবে, যেটি এ অর্থবছরে কমে গিয়েছে।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক, ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এবারের বাজেট ব্যবসাবান্ধব ও প্রশাসনবান্ধব হয়েছে, যেখানে আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে এবারের বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং আমরা একটি জনবান্ধব বাজেট পাব। কিন্তু এ বাজেট হয়েছে দুর্নীতি ও অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় ও বৈধতা দেওয়ার বাজেট, একটি সংবিধানবিরোধী বাজেট। যারা বেআইনি পদ্ধতিতে উপার্জন করছে, তাদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার বলেন, শিশুদের ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়ে। যেমন পারিবারিক ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে পুষ্টিহীনতা ও বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে ঝরে পড়া শিশুরা ভবিষ্যতের মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি হতে পারে না। শিশুদের প্রতি যে নির্যাতন বাড়ছে, তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে শিশুদের জন্য একটি আলাদা অধিদপ্তর করা যেতে পারে এবং তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, শ্রমজীবী মানুষ এ দেশের বড় একটি অংশ, যাদের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে বাজারমূল্যের কোনো সামঞ্জস্য নেই। অতিমারিকালে বেশিরভাগ শ্রমিকদের বেতন কমে যায়, অর্ডার বাতিল হয় এবং অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ে। শ্রমজীবীদের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা বাজেটে নেই। মালিকপক্ষ উন্নতির ভাগিদার হয়, কিন্তু ক্ষতির ভাগিদার হয় শ্রমিক। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট অনেক ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক খাতে বরাদ্দ রেখেছে, যেমন নারীদের কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে বাজেটে কোনো বরাদ্দ দেখা যায়নি, যেখানে আমরা জানি অতিমারিকালে সহিংসতা অনেক বেড়েছে, সেখানে সামাজিক সুরক্ষার বাজেটে সহিংসতার বিরুদ্ধে কোনো বরাদ্দ নেই।
আরএম/আরএইচ