উপেক্ষিত শিশুরা : প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বাজেটে নেই প্রতিফলন
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের (১৯৭২-৭৩ অর্থবছর) আকার ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এরপর সময় অনেক গড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক, সামরিক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মিলে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫১বার বাজেট ঘোষণা হয়েছে। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের ২২তম বাজেট। পরপর গত তিন বছর শিশু বাজেট ঘোষণা করেনি সরকার। অথচ বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর সাত কোটিই শিশু।
২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর সবাই শিশু হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ এই বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সংখ্যায় তারা সাত কোটির বেশি। তাদের জন্য বাজেটের ২০ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের
করোনার সংক্রমণ কমতির দিকে থাকলেও করোনা যায়নি। করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার শিশুরা। অথচ প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় শিশুদের করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য কী করণীয় তা-ও পরিষ্কার করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাকালে স্কুল বন্ধ রাখায় অপূরণীয় ক্ষতির মধ্যে পড়ে শিশুরা। যদিও পরবর্তী সময়ে শিশুদের অনলাইনে ক্লাস করানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন সুবিধা না থাকায় বিরাট অংশের শিশু এই কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি। তাই এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট প্রতিবেদন প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে শিশুকেন্দ্রিক বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল, ২০২০ সালের মধ্যে শিশুদের জন্য বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু গত দুই বছরের ন্যায় এবারও শিশুকেন্দ্রিক কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই প্রস্তাবিত বাজেটে।
সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিশু বাজেট প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বিকশিত শিশু : সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্মিলিত বাজেট বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল শিশুকেন্দ্রিক বাজেট ছিল ৮০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল বাজেটের ১৫ শতাংশের মতো। বিষয়টি বাজেটের পৃথক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে (ইউএনসিআরসি) উল্লিখিত শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এই সনদে স্বাক্ষর করে। সনদের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করে। এছাড়া ২০১১ সালে জাতীয় শিশুনীতি গ্রহণ করে সরকার। সেই আলোকে বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন প্রণয়ন করে আসছিল সরকার।
২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর সবাই শিশু হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ এই বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সংখ্যায় তারা সাত কোটির বেশি। তাদের জন্য বাজেটের ২০ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের।
দেশের জাতীয় বাজেটে সর্বপ্রথম ‘বাজেট থটস ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। পরবর্তী সময়ে ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এই বাজেট দেওয়া হয়েছিল। পরে আকস্মিক কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
জানা যায়, সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিশুকেন্দ্রিক নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগ।
সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিশু বাজেট প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বিকশিত শিশু : সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্মিলিত বাজেট বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল শিশুকেন্দ্রিক বাজেট ছিল ৮০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল বাজেটের ১৫ শতাংশের মতো। বিষয়টি বাজেটের পৃথক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ধীরে ধীরে শিশুকেন্দ্রিক এই বরাদ্দ বাজেটের ২০ শতাংশে উন্নীত করার বিষয়ে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরপর তিনটি অর্থবছরে শিশু বাজেট বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে না। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বাজেটে।
বাজেট পরবর্তী পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অথচ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে ২০২০ সালের মধ্যে তারা বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে শিশুদের কল্যাণে। কিন্তু বর্তমানে শিশুকেন্দ্রিক কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।’
সরকারের তরফ থেকেই স্বীকার করা হয়েছে যে দেশের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অন্যতম উত্তম পন্থা হলো শিশুদের ওপর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে জাতীয় বাজেটে শিশুর হিস্যা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা, সমতা ও জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে ব্যয় হচ্ছে কি না, তাও সার্বক্ষণিক পরিবীক্ষণ করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. ওয়াহিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার্বিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো একটি সুস্থ, সবল ও সুদক্ষ শ্রমশক্তি এবং একটি সৃজনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে তোলা। এজন্য প্রয়োজন শিশুর বিকাশে সামর্থ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্পদের সুদক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা। করোনাকালে শিশুরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ এবারও শিশু বাজেট ঘোষণা করা হয়নি। এটা উচিত ছিল, এখনও সময় আছে। আরও বড় প্রয়োজন সরকারের শিশুকেন্দ্রিক বাজেটের শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এবং কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য ক্ষতির হিসাব করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তাদের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, স্কুল বন্ধ থাকায় জিডিপির ক্ষতি হয়েছে ৩.১ শতাংশ। এ কারণে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে দক্ষ কর্মসংস্থান ৩.১৮ শতাংশ এবং অদক্ষ কর্মসংস্থান ৩.১৬ শতাংশ হ্রাস পাবে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের উচিত শিশুদের শেখার সুযোগ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা। পাশাপাশি শিক্ষা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা এবং ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দারিদ্র্য হ্রাসের হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও এখনও দেশে ৩৫.৭ মিলিয়ন দরিদ্র লোক রয়েছে যার মধ্যে ১৮.৫ মিলিয়ন অতিদরিদ্র। অপরদিকে, সম্প্রতি আয় গিনি সূচকের মাধ্যমে পরিমাপকৃত অসমতাও কিছুটা বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, শিশুরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তারা দেশ গঠনে যাতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে এবং করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি তাদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আলাদা বিনিয়োগ করতে হবে। প্রত্যেক শিশুর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা সৃষ্টি করা যা কেবলমাত্র বর্ধিত শিশু বিনিয়োগ হতে মেটানো সম্ভব।
সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের তো প্রতিশ্রুতি আছে। করোনা মহামারির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কথা যখন বলা হচ্ছে তখন বাজেটে শিশুকেন্দ্রিক বরাদ্দ উপেক্ষিত। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার মোট বাজেটের কী পরিমাণ শিশুদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে তার মূল্যায়ন করা উচিত, স্পষ্ট হওয়া উচিত শিশু বাজেট। সরকার চাইলে হিসাব করে জুলাই মাসেও তা জানাতে পারে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশের শৈশবকালীন খর্বাকৃতির হার এখনও ৩৬ শতাংশ এবং বাল্যবিবাহের আধিক্যও দৃশ্যমান। কিশোরী গর্ভধারণের হারও বিশ্বের সমতুল্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নাজমা শাহিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশু দারিদ্র্য বিমোচন, শিশুশ্রমের অবসান, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জোগান, অপুষ্টি দূরীকরণ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়া রোধ, সহিংসতা ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের উদ্ধারে প্রয়োজন যেমন পর্যাপ্ত শিশু বাজেট, তেমনি বিনিয়োগও।
তিনি বলেন, শৈশবের দারিদ্র্য পরিণত বয়সের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। জীবনের শুরুতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষার মতো মৌলিক সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত হলে তা মানুষের শরীর ও মনের দীর্ঘমেয়াদে অস্থায়ী ক্ষতির প্রভাব ফেলে।
‘উদাহরণস্বরূপ, জীবনে প্রথম তিন বছরে পুষ্টির অভাব শিশুদের মস্তিষ্ক ও শরীরের ক্ষেত্রে স্থায়ী ক্ষতিসাধন করে। এমতাবস্থায় করোনা আমাদের মধ্যে অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে এসেছে। যার বেশি প্রভাব ফেলেছে শিশুদের মধ্যে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার এসব ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক, কতটা তৎপর তা বাজেটে স্পষ্ট বরাদ্দের মাধ্যমে দেখানোর সুযোগ ছিল। সরকার চাইলে এখনও সেটা সম্ভব।
জেইউ/এমএআর