উৎসে কর ০.৫% বহাল রাখার দাবি বিজিএমইএ’র
পোশাক রপ্তানির ওপর উৎসে কর ০.৫০% বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
সোমবার (১৩ জুন) দুপুরে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পোশাক রপ্তানির উপর উৎসে কর ০.৫০% থেকে বৃদ্ধি করে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য অত্যন্ত দুরুহ হবে। যখন কি না এ শিল্প মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তাই কর বাড়ানোর জন্য এটা সঠিক সময় নয়। বর্তমানে অস্থিরতাময় বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি আমাদের পোশাক শিল্পের জন্যও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে এই উৎসে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব পোশাক শিল্পের টিকে থাকার সংগ্রামটি আরও কঠিন করে তুলবে।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে একদিকে যেমন জ্বালানি তেলসহ খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ইউরোপসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কাও বাড়ছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতিও তীব্র আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশগুলো সুদের হার বাড়াচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা ও ক্রয় ক্ষমতা কমেছে এবং সামনে আরও কমে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত ৭ জুন বিশ্ব ব্যাংক তাঁদের সর্বশেষ Global Economic Prospects প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব এবং স্থবির চাহিদার কারণে অর্থনৈতিক মন্দা তীব্র হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, পোশাক রপ্তানিতে বর্তমানে যেই প্রবৃদ্ধিটি দেখা যাচ্ছে, সেটি আগামীতে চলমান থাকার লক্ষণ আমরা দেখছি না। বরং বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, যেখানে ২০২১ সালে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৩%, সেটা ২০২২ সালে ৪% এ নেমে আসবে।
সেই সাথে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ, কনটেইনার ভাড়া, ডিজেলে মূল্যসহ সামগ্রিক উৎপাদন খরচ বিগত ৫ বছরে গড়ে প্রায় ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সম্প্রতি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ডলার শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। ডলারের বিপরীতে ইউরো যেভাবে মান হারাচ্ছে, তাতে করে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইউরো ও ডলারের মূল্য সমান পর্যায়ে চলে আসতে পারে, অর্থাৎ ১ ইউরো নিয়ে ১ ডলার পাওয়া যাবে। ফলে ইউরোপের বাজারে আমাদের পণ্যের মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়াটা অস্বাভাবিক নয়,’ যোগ করেন তিনি।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, বিগত প্রায় দুই বছরে করোনার কারণে যেখানে আমাদের তেমন কোনো কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রেমিট্যান্সে মন্দাভাব ও আমদানি ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যালেন্স জব পেমেন্টে চাপ তৈরি হয়েছে। আর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দার যে পূর্বাভাস আমরা পাচ্ছি সেটা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ পরিস্থিতিতে সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত, পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা যেকোনোভাবেই হোক মসৃণ রাখা জরুরি। তাই পোশাক শিল্পে উৎসে কর বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, সে অবস্থায় রাখার বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় অর্থমন্ত্রী সুবিবেচনায় রাখবেন বলে আশা করছি।
সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে কর ০.৫০% আগামী ৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর রাখলে শিল্পটি বর্তমান সংকটকালীন সময়ে স্বস্তিতে থাকবে। শিল্প টিকে থাকলে রাজস্ব আসবে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমাদের পোশাক রপ্তানি ছিল ২৭.৯৫ বিলিয়ন ডলার, ৮৩.৪৫ টাকা এক্সচেঞ্জ রেট হিসেবে টাকার অংকে রপ্তানি আয় হয়েছিল ২ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ০.৫০% হারে উৎসে ১,১৬৬ কোটি টাকা উৎসে কর প্রদান করা হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার, ৮৩.৯৫ টাকা এক্সচেঞ্জ রেট হিসেবে টাকার অংকে রপ্তানি আয় হয়েছিল ২ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ০.৫০% হারে উৎসে ১,৩২০ কোটি টাকা উৎস কর প্রদান করা হয়। আর চলতি অর্থবছর ২০২১-২২ শেষে রপ্তানি ৪১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করছি, ৮৭ টাকা এক্সচেঞ্জ রেট হিসেবে টাকার অংকে রপ্তানি আয় হবে ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ০.৫০% হারে উৎসে ১,৭৮৩ কোটি টাকা উৎসে কর প্রদান করা হবে।
আর সামনের অর্থবছর ২০২২-২৩ এ আমরা যদি ৪৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারি তবে ৯২ টাকা এক্সচেঞ্জ রেট হিসেবে টাকার অংকে রপ্তানি হবে ৪ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ০.৫০% হারে উৎস ২,০৭০ কোটি টাকা উৎসে কর প্রদান করা হবে। অর্থাৎ আমরা যদি প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বাড়াতে পারি, তাহলে কর হার না বাড়িয়েও রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হবে। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতি উপকৃত হবে।
ফারুক হাসান বলেন, আমরা নন-কটন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি উৎসাহিত করতে, নন-কটন পোশাক রপ্তানির উপর ১০% হারে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করছি। আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৭৪% কটনের তৈরি, যেখানে বিশ্বের মোট টেক্সটাইল কনজাম্পশনে কটনের শেয়ার মাত্র ২৫%। বর্তমান বিশ্বে ভোক্তাদের ক্রমাগত জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে নন-কটন পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ২০১৭ সালে MMF বেসড টেক্সটাইল ট্রেডের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশের শেয়ার ছিল মাত্র ৫%, অথচ আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের দখলে ছিল ১০% শেয়ার। বিগত দশকে আমাদের দেশে নন-কটন, বিশেষত ম্যান-মেড ফাইবার খাতে কিছু বিনিয়োগ হলেও এসকল বিনিয়োগ মূলত মূলধন এবং টেকনোলজি নির্ভর। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোতে শিল্পের কাঁচামাল থাকায় এবং তাদের স্কেল ইকনোমির কারণে তারা প্রতিযোগী সক্ষমতায় অনেক এগিয়ে আছে। তাই নন-কটন বস্ত্রখাতে বিনিয়োগ সুরক্ষিত ও উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ নীতি সহায়তা একান্ত অপরিহার্য।
তিনি বলেন, আমরা নগদ সহায়তার ওপর প্রযোজ্য ১০% আয়কর প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। যেহেতু নগদ সহায়তা কোন ব্যবসায়িক আয় নয়, তাই নগদ সহায়তার অর্থকে করের আওতার বাইরে রাখাই যুক্তিযুক্ত। পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরির অন্যতম উপাদান সোলার প্যানেল আমদানিতে শুল্কহার শূন্য থেকে বাড়িয়ে ১% করা হয়েছে। শিল্পে পরিবেশগত টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সূচিত হয়েছে, তার ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সোলার প্যানেল আমদানিতে শুল্কহার শূন্য করা হোক।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের স্মরণে মোনাজাত ও এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।
এএজে/এনএফ