এক ধাক্কায় টাকার মান কমেছে ২৫ পয়সা
দেশে ব্যাপক হারে পণ্য আমদানি বেড়েছে। ফলে বাড়তি চাহিদার কারণে বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম। মান হারাচ্ছে টাকা। এক দিনেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ পয়সা কমেছে।
বুধবার (২৭ এপ্রিল) আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে কিনতে খরচ হয়েছে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। একদিন আগে মঙ্গলবারও এক ডলারে লেগেছিল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা।
ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে তিন থেকে চার টাকা বেশি দরে। ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার ৯২ থেকে ৯৩ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে আমদানির চাপ ব্যাপক হারে বেড়েছে। সেই অনুযায়ী প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়েনি। যার কারণে আমাদনির দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে করে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। তবে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২০ সালের জুলাই থেকে গেল বছরের আগস্টের পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল ডলার। কিন্তু এর পর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয়ের পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়।
২০২১ সালের আগস্টের শুরুতেও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য একই ছিল। এরপর ৩ আগস্ট থেকে দু-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ৮৫ টাকা ছাড়ায়। এরপর গত ৯ জানুয়ারিতে এটি বেড়ে ৮৬ টাকা পৌঁছে যায়। এরপর ২২ মার্চ পর্যন্ত এ রেটেই স্থির ছিল। পরে গত ২৩ মার্চ আন্তঃব্যাংকে আরও ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২৭ এপ্রিল আরেও ২৫ পয়সা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। অর্থাৎ গত প্রায় ৯ মাসে প্রতি ডলারে দর বেড়েছে এক টাকা ৬৫ পয়সা। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড মূল্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যখন বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেশি ছিল তখন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন সরবরাহ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪৬০ কোটি (৪.৬০ বিলিয়ন) ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে পারছে না। গত অর্থবছরের আগে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ ডলার কেনার রেকর্ড করেছিল আর্থিক খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো চাইলেও বাড়তি ডলার নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। বৈদেশিক মুদ্রা রাখার বিষয়ে প্রতিটি ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা আছে; যাকে এনওপি বা নেট ওপেন পজিশন বলে। যদি কোনো ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ডলার মজুত থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়। আর না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হবে। কেউ নির্ধারিত সীমার বাইরে ডলার নিজেদের কাছে ধরে রাখলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা গুণতে হয়। জরিমানার হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে ধরে রাখতে পারে। এর অতিরিক্ত হলেই তাকে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হবে।
আমদানি-রপ্তানি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। আলোচিত আট মাসে রপ্তানি থেকে দেশ আয় করেছে তিন হাজার ২০৭ কোটি ডলার। পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৩৮ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় থেকে রপ্তানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় দুই হাজার ২৩০ কোটি ডলার।
রেমিট্যান্স
গেল মার্চ মাসে প্রবাসীরা ১৮৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। যা আগের মাসের চেয়ে ২৪ শতাংশ বা ৩৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলার বেশি। গত ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৯ কোটি ডলার।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে রেমিট্যান্স বাড়লেও গত বছরের একই সময়ের তুলনা করলে তা কমেছে। গত বছরের মার্চে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯১ কোটি ৯ লাখ ডলার।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চে) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৫২৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা)। এ অংক আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩০ কোটি বা প্রায় ১৮ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম ৯ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৮৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার।
রিজার্ভ ৪৪.৩০ বিলিয়ন ডলার
আমদানির চাপে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নেমে এসেছে ৪৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন বা চার হাজার ৩০০ কোটি ডলাররে। গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
এসআই/ওএফ