সমুদ্রে ভাসছে অসংখ্য জেলিফিশ, বেকায়দায় জেলেরা
বঙ্গোপসাগরে ভাসছে অসংখ্য জেলিফিশ। এই জেলিফিশের কারণে চরম বেকায়দায় পড়েছেন উপকূলের জেলেরা। সমুদ্রে জাল ফেলতে পারছে না তারা। জালে আটকে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মেরুদণ্ডহীন এই প্রাণী। ছিঁড়ে যাচ্ছে জেলেদের জাল। তাই বাধ্য হয়ে জাল তুলতে হয়েছে মৎস্যজীবীদের। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন উপকূলের শত শত সমুদ্রগামী জেলেরা। গত ১৫ দিন ধরে এসব জেলিফিশ জেলেদের জালে জড়াচ্ছে।
সমুদ্র সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, কুয়াকাটা সৈকতের আন্ধারমানিক মোহনার লেম্বুরচর থেকে পূর্ব দিকে কাউয়ারচর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শত শত জেলিফিশ। এছাড়াও কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে ৪০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ গভীর সমুদ্রে জেগে ওঠা চরবিজয়ের বালুতে শত শত জেলিফিশ আটকে আছে। জেলেদের জালে জড়িয়ে মারা যাওয়া জেলিফিশগুলো স্রোতে ভেসে সৈকতের যেখানে সেখানে পড়ে রয়েছে। এগুলো পচে এক ধরনের পোকার জন্ম হয়েছে। দুর্গন্ধে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।
অতিরিক্ত জেলিফিশের কারণে বেকার মৎস্য শ্রমিকরা ছেঁড়া বুনছেন। কেউ কেউ সমুদ্রে থেকে জাল তুলে তীরে নিয়ে আসছেন। কেউ আবার শ্যাওলা ধরা জাল ধুয়ে রোদে শুকাচ্ছেন। খুঁটা জালের মাছ ধরা ট্রলারগুলো সৈকতে নিরাপদে রাখছেন।
সৈকতের পূর্ব দিকে ঝাউবাগান পয়েন্টে মম্বিপাড়া গ্রামের জেলে রবিউল বলেন, গত ১৫ দিন ধরে নোনার (জেলিফিশ) জন্য ঠিকমত মাছ ধরতে পারছি না। সব জাল ছিঁড়ে গেছে। এখন ছেঁড়া জাল বুনছি।
লেম্বরবন এলাকার প্রবীণ জেলে ইউনুচ দালাল বলেন, এ বছর সাগরে অনেক বেশি জেলিফিশ ভাসতে দেখা যাচ্ছে। পানিতে ভাসা অবস্থায় এগুলো কোনোটা চাঁদের মতো আবার কোনোটা অক্টোপাসের মতো দেখা যায়।
চর গঙ্গামতি এলাকার জেলে হারুন প্যাদা বলেন, গত কয়েকদিন ধরে ঝাঁকে ঝাঁকে এসব জেলিফিশ সাগরে ভাসতে দেখছি। আমাদের জালে এগুলো আটকে যায়। তবে জালে আটকা পড়লে আমরা ছাড়িয়ে দিলেও সেগুলো আর বাঁচে না।
মুসুল্লীয়াবাদ গ্রামের জেলে আব্দুল জলিল হাওলাদার জানান, প্রতি বছরই নোনা (জেলিফিশ) আসে। কিন্তু এ বছর পরিমাণে অনেক বেশি। অতিরিক্ত জড়ানোর কারণে স্রোতে জাল ছিঁড়ে যায়। সব জাল কূলে এনেছেন। এখনও ছেঁড়া জাল মেরামত করবেন।
হোসেনপাড়া গ্রামের জেলে মো. সোহরাফ হোসেন জানান, জালে জড়ানো জেলিফিশগুলো তারা সমুদ্রে ফেলে দেন। কিছু বেঁচে গেলেও বেশিরভাগ মারা যায়। কারণ এগুলো জালে জড়ালে কেটে ভাগ ভাগ হয়ে যায়। মারা যাওয়া নোনাগুলো (জেলিফিশ) জোয়ারের স্রোতে কূলে ভেসে আসে। এখন এগুলো পচে পোকা হয়েছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
মম্বিপাড়া রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকার জেলে মো. ইদ্রিস গাজী বলেন, গত ১৫ দিন ধরে হঠাৎ নোনা (জেলিফিশ) জালে জড়াচ্ছে। শুরুর দিকে কম থাকলেও এখন পরিমাণে অনেক বেশি। যার কারণে মাছ ধরতে পারছি না। জালপালা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই জাল তুলে এনেছি। নোনা না কমা পর্যন্ত সাগরে জাল ফেলব না।
ইকোফিশ-২ প্রকল্পের পটুয়াখালী জেলার সহকারী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, এ জেলিফিশগুলো জোয়ারের স্রোতে ভেসে এসে সৈকতের বালুতে আটকে মারা যায়। এরা সাঁতারে পারদর্শী না হওয়ায় ভাটার স্রোতে নেমে যেতে পারে না। তবে হঠাৎ করে জেলিফিশের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রের স্বাস্থ্য ঠিক নেই। আবার এও হতে পারে জেলিফিশ যেসব মাছের খাবার, সেসব মাছ কমে গেছে। যার ফলে এর সংখ্যা বেড়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, জেলিফিশের শরীর খুবই বিষাক্ত। তাদের সংস্পর্শে আসা অন্যান্য মাছের পোনাও মারা যাচ্ছে। গবেষণা করলে হয়তো সঠিক কারণ শনাক্ত হবে।
কলাপাড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, সমুদ্রের জেলিফিশগুলো মূলত আওরেলিয়া ও আওরেটা প্রজাতির। মেরুদণ্ডহীন এসব প্রাণী চাঁদের মতো দেখতে বলে এদেরকে মুন জেলিফিশও বলা হয়। এগুলো মূলত সাঁতারে তেমন পারদর্শী নয়। অনেক সময় খাদ্য অন্বেষণ কিংবা বাতাসের টানে ওপরের দিকে চলে আসে। পরে বালুতে আটকা পরে মারা যায়। প্রতি বছর এই সময়ে উপকূলীয় এলাকায় জেলিফিশের দেখা মেলে। এগুলো বেশি দিন স্থায়ীভাবে থাকে না। গরমের প্রভাব বাড়লে জেলিফিশ কমে যাবে।
কাজী সাঈদ/আরএআর