বালু উত্তোলনই নদীতীরবর্তী মানুষের আতঙ্ক
‘নদীর এ-কূল ভাঙে, ও-কূল গড়ে এইতো নদীর খেলা।’ চিরন্তন সেই সুরের সঙ্গে নদী ভাঙনের খেলা যেন নিরন্তর। একটা সময় ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদীতীরের বাসিন্দাদের ভাঙন আতঙ্কের অন্যতম কারণ। এখন অবৈধভাবে বালু উত্তোলনই মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় নদীতীরবর্তী মানুষের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আগে নদী ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করত। বর্তমানে নদীর সেই স্রোত নেই। তাছাড়া নদীর তীররক্ষা বাঁধসহ সরকারি নানা পদক্ষেপে নদী ভাঙন কমে এসেছিল। কিন্তু এক শ্রেণির বালুদস্যুদের কারণে সেই নদী এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নদীর পাড় ভাঙছে। তীররক্ষা বাঁধে ধস নামছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, অবৈধ বালু উত্তোলন দেখলেই নদীতীরবর্তী মানুষের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ তৈরি হচ্ছে। তারা চিন্তিত হয়ে পড়ছেন ঘরবাড়ি সরানোর চিন্তায়। বালুদস্যুরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকে কথাও বলতে পারেন না। যারা বলেন তারাও এর কোনো প্রতিকার পাননি।
ঝামা বাজার বণিক সমিতির সভাপতি রেজাউল করিম চুন্নু বলেন, গত ১০ জানুয়ারি মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন দেওয়া হয়। যার অনুলিপি দেওয়া হয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে। অভিযোগ সত্ত্বেও এখনও মহেষপুর, চরঝামা, দিকমাঝি, দেউলি, হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
শতাধিক লোকের অভিযোগে জানানো হয়, ১৯৯৬ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নদী ভাঙনরোধে মহম্মদপুর উপজেলার ঝামা এলাকায় ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করে। অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় বাঁধে ধস নেমেছে।
অভিযোগে আরও জানা যায়, ভরা বর্ষায় বালু উত্তোলন করায় মহেশপুর, চরঝামা, দিকমাঝি, দেউলি, হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের শত শত একর জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝামা বাজার, মহেশপুর ও দিকমাঝি নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে। তাছাড়া ঝামা ফাজিল মাদ্রাসা, ঝামা হাইস্কুল এবং দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হুমকির মুখে রয়েছে।
ঝামা গ্রামের নদীতীরবর্তী শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, ‘আমার বাড়ির সামনে থেকে বালি তুলা হয়। আমার ঘরবাড়ি একেবারেই ভাঙনের মুখি। যেকোন সময় ঘরবাড়ি নদীতে চলে যাবে। আমি আতঙ্কে ঘুমাতি পারিনে।’
ইকবাল হোসেন নামে এক তেল ব্যবসায়ী বলেন, ‘২৫-২৬ বছর ধরে বেড়িবাঁধে ধস নামে নাই। আমরা নিশ্চিন্তে বাস করেছিলাম। এখন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় আমারা আতঙ্কে আছি।’
আনোয়ার নামে এক ব্যবসায়ী জানান, ‘যদি অবৈধ বালি উত্তোলন চলতে থাকে তাতে সরকারের কোনো পদক্ষেপই সফল হবে না।’
হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা জামাল শেখ জানান, ‘অবৈধ বালি উত্তোলনের কারণেই হরেকৃষ্ণপুর এলাকায় নদী ভাঙে। এটা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না। শত শত মানুষ গৃহহীন হচ্ছে বালি উত্তোলনের কারণে। আগামীতে দেখবেন আরও কয়েকশ মানুষ ঘরবাড়ি হারাবেন। আগের বছর নদীর ভাঙনে অসংখ্য ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, গাছপালা ও মসজিদ বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিবছরই ভূমিহীন হচ্ছেন কোনো-না-কোনো পরিবার।’
মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সরোয়ার জাহান সুজন বলেন, আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে ঝামা এলাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে বালু উত্তোলনের কারণে বাঁধে ধস নামছে। জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।
মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রামানন্দ পাল বলেন, আমি ঝামা এলাকায় সরেজমিনে যাব। তাছাড়া অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে এবছর বেশ কয়েকটি অভিযান করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে।
জালাল উদ্দিন হাককানী/এমএসআর