সোহেল-রওশনের নজিরবিহীন ভালোবাসার ১৪ বছর
ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৪ বছর আগে ভালোবেসে রওশনের হাত ধরেন সোহেল। তাদের এই চলার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। কেননা অন্য আর দশটা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক নন ময়মনসিংহের ত্রিশালের রওশন আক্তার। তবে ভালোবাসা অন্ধ তার প্রমাণ দিয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সোহেল মিয়া। ভবিষ্যত নানা সমস্যা আসবে জেনেও সকলের অমতে আবদ্ধ হন বিয়ের বন্ধনে।
জানা গেছে, জন্ম থেকেই দুই পা অচল রওশনের। পায়ে ভর দিয়ে নেই চলার শক্তিটুকুও। স্বামীর পিঠে চড়ে চলাচল করেন এখানে-সেখানে। হয়েছেন সন্তানের মা। কঠিন এ জীবন সংগ্রামে মসৃণ পথ তৈরির মূলে ছিল প্রেম, ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাস।
৮ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সোহেল মিয়া। ছোটবেলায় হারিয়েছেন বাবা-মাকে। ভাই-বোনের কাছে থেকে পড়াশোনা করেছেন । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ভালো চাকরি নেন সোহেল। এক পর্যায়ে সচ্ছলতার জীবন ছেড়ে অভাবের সংসার মেনে নিয়েছেন অসহায় স্ত্রীর পাশে থাকতে। ভালোবাসা যেখানে অভাব অনটন দেখে দৌঁড়ে পালায়, সেখানে অভাবকে ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন এ দম্পতি।
সোহেল মিয়া বলেন, পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করতাম। এক দিন বিকেলে অফিস ছুটির সময় আমার টেবিলের ড্রয়ারে থাকা একটি ১০ টাকার নোটে একটি নম্বর লেখা দেখতে পাই। ওই নম্বরে এক দিন কল করি। সেই কলের মাধ্যমেই রওশনের সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয়। আস্তে আস্তে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে আমাদের প্রেমের শুরুটা হলেও আমরা ডিসেম্বরে গিয়ে বিয়ে করি।
তিনি আরও বলেন, শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম থাকলেও তার ভেতরে আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি আজ পর্যন্ত পাইনি। একজন স্বাভাবিক মেয়ে স্বামীর জন্য যতটুকু না করতে পারে সে তার চেয়েও বেশি কিছু করার চেষ্টা করে। সে আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। আর আমিও তার প্রতি পুরোপুরি দুর্বল।
রওশন আক্তার বলেন, আমি প্রতিবন্ধী হওয়ায় আমার পরিবার থেকেও বিয়েতে সম্মতি ছিল না। সে সময় সবাই বলাবলি করেছে, বিয়ের পর আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি যাকে ভালোবাসব সেও আমাকে ভালোবাসবে। এই বিশ্বাসটাই আমি সোহেলের ওপর করতে পেরেছিলাম। সেজন্য সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার হাত ধরে আমি পালিয়ে যাই এবং বিয়ে করি। মেয়ে হওয়ার পর আমাদের ভালোবাসা যেন আরও বেড়ে গেছে।
ত্রিশালের গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামে ছোট্ট মাটির ঘর আর একটি টং দোকানই সম্বল এ দম্পতির। শত কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা আর পরস্পর আস্থা-বিশ্বাসই যেন তাদের কাছে সুখের পালক।
রওশন আক্তার বলেন, কখনো কোথাও যেতে চাইলে আমি শুধু বলি আর সে তার পিঠে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া-আসা করে। আমার মনের চাহিদা পূরণের জন্য সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে। তাকে আমি ধন-সম্পদ কিছুই দিতে পারিনি, শুধু আমার ভালোবাসাটুকুই দিয়েছি। আর সে আমার ভালোবাসা নিয়েই এখনো আমার সঙ্গে আছে। আমরা সুখেই আছি।
সোহেল মিয়া বলেন, আমাদের সময়ের ভালোবাসাটাই ছিল অন্যরকম। অচল-অক্ষম মেয়েকে যেভাবে অন্ধের মতো ভালোবেসেছি, তার মাঝেও তেমন ছিল অন্ধ প্রেম। এমন প্রেম এখন আর দেখা যায় না। এখনকার প্রেম হল প্রথমে দেখা, তারপর কথা, পরে অন্যকিছু। এই আছে এই নেই। কিন্তু আমাদের প্রেম ছিল পবিত্র, সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে পাওয়া।
সোহেল-রওশনের এমন নজিরবিহীন ভালোবাসার বন্ধন রীতিমতো অবাক করে স্বজন ও প্রতিবেশীদেরও। তারা বলেন, আমরা প্রথম অবস্থায় সোহেলকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ের পর কিছু দিন পর তাকে চলে যাক এমনটা আমরা চাইনি। তখন তাদের মতামতেই তারা বিয়েটা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে প্রেমের এতটা আকর্ষণ তা বুঝতে পারিনি। সত্যিকারের প্রেম যে কতটা গভীর তা তাদের দেখেই আমরা বুঝতে পারি। রওশনকে পিঠে নিয়ে সোহেল যেভাবে আনা-নেওয়া করে তা দেখে আমরা সত্যিই অবাক হই।
ভালোবাসা মানে একজনের কাছে আরেকজনের দায়বদ্ধতা। সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে থাকা। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার নামই ভালোবাসা। তবে স্বার্থের দুনিয়ায় যেখানে ঠুনকো আঘাতে সম্পর্ক ভাঙনের ছড়াছড়ি, সেখানে একজনের দু-পায়ে ভর দিয়ে দুটি মানুষ কাটিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার ১৪টি বছর।
এসপি