রাজেকার বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই মেলে স্বামী-সন্তানহারা মা-বাবার
‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে’... ভুপেন হাজারিকার বিখ্যাত সেই গানকে উপজীব্য করেই যেন সেবামূলক এক পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন বিমাকর্মী রাজেকা রহমান। রংপুরের পীরগাছায় অভাবী, অসহায়-দুস্থ ও স্বামী-সন্তানহারা বৃদ্ধ মা-বাবাদের জন্য নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে দেবী চৌধুরানী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। বর্তমানে এখানে ২৫ জন অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছেন। তাদের থাকা-খাওয়াসহ দেখাশোনা সবই করছেন রাজেকা নিজেই। তার চাকরির বেতনের বেশির ভাগ টাকাই ব্যয় করে দিচ্ছেন জীবনসায়াহ্নে আসা এই মানুষগুলোর পেছনে।
রাজেকা রহমান একসময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষের বাড়ি ঘুরেছেন। নিজ চোখে দেখেছেন অভাবে জর্জরিত পরিবারগুলোয় বয়স্ক মা-বাবাদের দুঃখ-কষ্ট আর বিড়ম্বনা। ছেলের সংসারে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি বউয়ের আড়চোখা আচরণ। আবার কোথাও দেখেছে জমি-জমার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ছেলে-মেয়েদের কারণেই ঘরছাড়া অসহায় মা-বাবাদের।
২০০১ সালে একটি লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বিমাকর্মী হিসেবে চাকরির শুরু রাজেকার। তখন থেকেই অসহায়-দুস্থ বয়স্কদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। অন্যের দুঃখ-কষ্ট দেখে তিনি নিজেই হাঁপিয়ে ওঠেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বৃদ্ধ মা-বাবাদের বঞ্চনা বিড়ম্বনা দুর্ভোগ দেখে কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। আবার কখনো তার মন কেঁদেছে। নিজের তেমন সাধ্য না থাকলেও তখনই মনস্থির করেছিলেন, বয়স্কদের পুনর্বাসনে কাজ করবেন।
যেই ভাবনা সেই কাজ। যদিও রাজেকার ভাবনার বাস্তব রূপ পেতে পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। ২০১৫ সালে কয়েকজন অসহায় ও অভাবী পরিবারের বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিজের বাড়িতে এনে আশ্রয় দেন রাজেকা। দিন দিন সেই সংখ্যাটা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। পরে আট হাজার টাকায় ১২টি রুমের একটি আধাপাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বৃদ্ধাশ্রম। সেটি এখন নিজের কেনা ২০ শতক জমিতে পেয়েছে নতুন রূপ, নতুন নাম। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমনটাই বলছিলেন রাজেকা রহমান।
পীরগাছা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে এবং রংপুর-সুন্দরগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের কৈকুড়ী ইউনিয়ন পরিষদের পাশে রাজেকার এই বৃদ্ধাশ্রম। ইতিহাসখ্যাত দেবী চৌধুরানীর নামে পরিচিত দেবী চৌধুরানী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। এখানে বর্তমানে ভাগ্যতাড়িত ২৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জীবনের পড়ন্তবেলায় পেয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়। পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে তিন বেলা উন্নত মানের খাবার, চিকিৎসাসেবা, ওষুধ, পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন অসহায় এসব বাবা-মা। তাদের জন্য প্রতি মাসে গড়ে ব্যয় হয় কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। রাজেকার বেতনের সঙ্গে স্বামীর ব্যবসার টাকাও জোগান দিতে হয় কখনো। তবে স্থানীয় দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে রাখছে বড় ভূমিকা।
ঢাকা পোস্টকে রাজেকা রহমান বলেন, ২০০১ সাল থেকে আমি বিমাকর্মী হিসেবে মাঠে কাজ শুরু করি। তখন অনেক ভালো ভালো পরিবারে দেখেছি বয়স্ক মা-বাবার করুণ পরিণতি। অথচ ওইসব পরিবারে কোনো অভাব নেই। শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বেলায় পরিবারের লোকজনেরা হাত গুটিয়ে থাকত। ঠিকমতো দুই বেলা দুমুঠো ভাত আর সেবাযত্ন না পেয়ে খুব কষ্টে থাকতেন ওই সব মা-বাবা। এসব দেখে আমার নিজের খুব খারাপ লাগত। আমি তখন থেকে মনে মনে চেয়েছি আল্লাহ্ যদি কখনো তৌফিক দান করেন, তাহলে এ রকম অসহায়, দুস্থ, অভাবী ও স্বামী-সন্তানহারা বৃদ্ধ মা-বাবাকে একসঙ্গে রেখে তাদের ভালো রাখার চেষ্টা করব।
এই বৃদ্ধাশ্রম শুরুর গল্পটা বলতে গিয়ে রাজেকা কিছুটা সময় নীরব থাকেন। তখন তার দুচোখে জল টলমল করছিল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রাজেকা বলেন, আমার এই বৃদ্ধাশ্রমের শুরুটা ছিল ভাড়াটে বাসায়। আমি যখন ফিল্ডে কাজ করি, তখন থেকেই ভেবেছিলাম একটা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করব। ২০১০ সালে আমার একটা অস্ত্রোপচার হয়। ওই অস্ত্রোপচার করার পর আমি ভাবলাম, আমি যা করতে যাচ্ছি (বৃদ্ধাশ্রম তৈরি), হয়তো ভবিষ্যতে আমি এটা করতে পারব না। তখন থেকে আমি বেতনের টাকা থেকে কখনো দুইটা খাট, কখনো মশারিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বানানো এবং সংগ্রহ শুরু করি।
আমি গরিব মানুষ। একসঙ্গে তো এতো সব কিছু করতে পারতাম না। তাই ধীরে ধীরে একটু গুচিয়ে নিয়ে ২০১৫ সালে একটা ভাড়া বাসাতেই শুরু করি বৃদ্ধাশ্রমের কাজ। প্রথম দিকে প্রায় ৫০-৫৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে অনেকেই পরিবারের কাছে চলে যান। তাদের অনেকে এখনো আমার খোঁজখবর নেন। এখন তারা ভালো আছেন। কেউ কেউ মারাও গেছেন।
রাজেকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে এ পর্যন্ত আট বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারা গেছেন। মৃত্যু-পরবর্তী দাফনকার্য সম্পাদনে কিছুটা জটিলতা হয়েছিল বলে জানান রাজেকা। তিনি বলেন, অনেক অসুস্থ মা-বাবা আমার এখানে ছিলেন। তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আটজন মারা যান। আমার বৃদ্ধাশ্রমে নিজস্ব কোনো কবরস্থান না থাকায় দাফন করা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পরে একটা পারিবারিক কবরস্থানে চারজনকে আর বাকি চারজনের দাফন ওয়ারিশদের মাধ্যমে হয়েছে।
এখন আমার কেনা ২০ শতক জমিতে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি রয়েছে। আমি এই জমিটা বৃদ্ধাশ্রমের নামে দান করেছি। এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের উন্নয়ন, থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য আমার অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। একার পক্ষে এসব করা সম্ভব না হলেও সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রাজেকা রহমান
একসময়ে এই সেবাশ্রমে বেশ কয়েকজন কর্মচারী থাকলেও বর্তমানে রাজেকা একাই সবকিছু দেখাশোনা করছেন বলে জানান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শুরুর দিকে অনেকেই ছিল। কিন্তু এখন আমার কর্মচারী নাই। এখন আমার সমস্যা, হাতের অবস্থাও ভালো না। এই বাড়ি, বৃদ্ধাশ্রম তৈরি পেছনে আমার যা অর্জিত সম্পদ-অর্থ ছিল, সবই এখানে শেষ করেছি। এখন আমি যা ইনকাম করি ওই টাকাতে চলি, বৃদ্ধাশ্রমও চালাচ্ছি। হয়তো কখনো কখনো কারও সাহায্য-সহযোগিতা পাই। কিন্তু এই মুহূর্তে লোক খাটানোর মতো আমার সামর্থ্য নেই। বৃদ্ধা মা-বাবাদের আমি সেবাযত্ন করি। তাদের হাত-পায়ের নখ কেটে দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, খাবার পরিবেশন, দেখভাল করাসহ টয়লেট-বাথরুম পরিষ্কার করার কাজগুলো আমাকেই করতে হয়। তবে অনেক বৃদ্ধা মা আছেন, যারা রান্নাবান্নায় আমাকে সাহায্য করেন। কেউ কেউ নিজেরা রান্নার পাশাপাশি থালাবাসনও পরিষ্কার করেন।
এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বেশির ভাগ মা-বাবাই অভাব অনটনে ভরা পরিবার থেকে আসা। যাদের ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই সংসার চালাতে হিমশিম খান। এ কারণে অনেকেই পরিবারের বোঝা হয়ে না থেকে জীবনের পড়ন্তবেলায় একটু ভালো থাকার আশায় এখানে এসছেন। আবার কোনো কোনো পরিবারে ছেলের সংসারে বউয়ের খারাপ আচরণ, অত্যাচার, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মা-বাবারা বাড়ি ছেড়ে এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত হয়েছেন। তাদের কেউ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, কেউবা ছোট চাকরি করেছেন। আবার অনেকে আছেন অঢেল সম্পদের মালিক। স্বামী-সন্তানহীন অনেক মা-বাবাও রয়েছেন এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
চাইলেই কোনো বৃদ্ধা মা-বাবা এখানে এসে থাকতে পারবেন না জানিয়ে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক রাজেকা রহমান বলেন, আমার এখানে ভর্তি ফরম আছে। সেখানে অঙ্গীকারনামা রয়েছে। যাদের এখানে রাখা হয়, ভর্তি ফরমে তাদের ওয়ারিশ বা গ্রামবাসী, নয়তো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে স্বাক্ষর করতে হয়। এখানে থাকা অবস্থায় কেউ খুব বেশি অসুস্থ হলে তাদের ওয়ারিশ বা পরিবারের লোকজনকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অন্যের সহযোগিতায় এখানে থাকতে আসেন।
রাজেকা বলেন, আমার এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে বাইরের অনেকেই আসেন। কেউ সাহায্য করতে আসে, আবার দেখতে আসে। এমনও হয়েছে, এই কেন্দ্র দেখে গিয়ে পরে নিজের বাবা-মাকে, আবার কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনকে এখানে রেখে গেছেন। এখন সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা নেই। তারা এখানে থেকে সেবাযত্ন পেয়ে সুস্থ হয়ে অনেকটা স্বাভাবিক ভাব জীবনে ফিরে ছেলে-মেয়েদের কাছে চলে গেছেন। সরকারি চাকরিজীবী ও বিডিআর, আর্মি এবং বেশ কয়েকজন ব্যাংকারও তাদের মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছিলেন। পরে অবশ্য তারা নিয়ে গেছেন।
মা-বাবাই সন্তানের সবচেয়ে আপনজন। এমনটা স্মরণ করে রাজেকা বলেন, যতই কষ্ট-যন্ত্রণায় দিন কাটুক না কেন, তারা চান না সন্তানের অমঙ্গল হোক। তারা কষ্টে থাকুক। সব সময় তারা কামনা করেন সন্তানের সাফল্য। নিদারুণ বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রে এই মা-বাবাই একসময় সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে যারা রয়েছে, কারো পরিবারের অবস্থা খারাপ, আবার কারও কারও পরিবাব অভাব নেই। কেউ কেউ পরিচর্যার অভাবে পরিবারে কষ্টে থাকতেন।’
‘সবার সুখে হাসব আমি কাঁদব সবার দুখে,
নিজের খাবার বিলিয়ে দিব অনাহারির মুখে।
আমার বাড়ির ফুল বাগিচা ফুল সকলের হবে
আমার ঘরের মাটির প্রদীপ আলোক দিবে সবে।’
পল্লিকবি জসীমউদদীনের ‘সবার সুখে হাসব আমি’ কবিতার চরণ উচ্চারণ করে রাজেকা জানান, এই কবিতা সব সময় অনুপ্রাণিত করেছে আমাকে। বলেন, মানুষের জন্য কিছু করতে তাড়িত করেছে। আমি যখন প্রতিদিন বিমার কাজে গ্রামগঞ্জে ঘুরি। এ সময় অনেক পরিবারে অভাব-অনটনে অনাদরে থাকা মা-বাবাকে দেখি। রাস্তায় বের হলে ভবঘুরে বৃদ্ধকে ভিক্ষাবৃত্তিসহ অসহায় অবস্থায় দেখতে পাই। এসব মা-বাবাকেই আমার আপনজন মনে হয়। তাই তাদের নিয়ে এসে নিজে যা খাই, তাদেরও তা-ই খাওয়াই। তবে আর্থিক সংকট থাকায় কিছুটা সমস্যা আমার রয়েছে। তারপরও এই বৃদ্ধাশ্রমটিতে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মা বাাবাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রাজেকার বিয়ে হয় সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গাতে। স্বামী মিজানুর রহমান ব্যবসা করেন। এক ছেলে সন্তান নিয়ে রাজেকা এখন পীরগাছার চৌধুরানী এলাকায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার সংগ্রামপুর গ্রামে। আমাদের নয় ভাই-বোনের মধ্যে সবাই ভালো কিছু করছে। আমি শুধু নিম্ন পর্যায়ে লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বিমাকর্মী করছি। বড় ভাই আর্মির অফিসার। ছোট দুই ভাই ব্যবসা করে। এক ভাই দেশের বাইরে থাকে। বোনদেরও ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। আমার বিয়ে হয়েছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গায়। কিন্তু আমি ওখানে থাকি না। স্বামীর ব্যবসার কারণে ছেলেকে নিয়ে চৌধুরানীতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে আশ্রিতরা কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউবা নামাজ পড়ছেন। কেউবা বিভিন্ন কাজে সময় পার করছেন। সেখানে কথা হলে ৭৫ বয়সী বৃদ্ধ নছিম উদ্দিন বলেন, একটা ব্যাটা (ছেলে) আছে, তায় নিজে চইলবার (সংসার চালাতে) পারে না। মোর দেখাশোনা করার মানুষ নাই।
বউ (স্ত্রী) মারা গেইছে অনেক আগোত। তায় (স্ত্রী) না থাকাতে মোর আইজ এই বিড়ম্বনা। অসুখ হইলে কায়ো দেখে না। খুব কষ্ট হয়। ব্যাটার বউও দেখে না। অভাব আর কষ্টোত না থাকি মুই এই বৃদ্ধাশ্রমোত আচু। আগের এ্যলা ভালো আচু। কোনো কষ্ট নাই। খাওয়াদাওয়া, ওষুধপাতি সোগ কিছু এ্যটে টাইম মতো মেলে। এই রাজেকা হামার ভরসা।
তিন ছেলের কেউই বেঁচে নেই। আর পাঁচ মেয়ে থাকলেও স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিধবা মায়ের খোঁজখবর নেয় না কেউ। এ কারণে ষাটোর্ধ্ব ছমেনা বেওয়া আশ্রয় নিয়েছেন দেবী চৌধুরানী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখানে ঢাকা পোস্টকে শোনালেন জীবনের শেষবেলায় এসে তার করুণ বাস্তবতা গল্প। ছমেনা বেওয়া বলেন, স্বামী মরছে অনেক আগোত। ব্যাটা তিনটাও বাঁচি নাই। মেয়েরা থাকি লাভ কী। তিনটা ঢাকাত থাকে, আর দুইটা গ্রামোত। সবাই স্বামী সংসার নিয়্যা ব্যস্ত। কায়ো সে রকম খোঁজ নেয় না। ঢাকার মেয়েরা মাঝে মধ্যে ফোনোত কতা কয়।
রাজেকার এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে দেখা হয় রফিকুল ইসলাম নামে এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে। তিনি মিঠাপুকুরের ঘুঘুবাড়ি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করেছেন। এখন জীবনের শেষান্তে তারও ঠাঁই হয়েছে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বৃদ্ধ বলেন, আশ্রয়দাতা রাজেকা বেগম আমাদের মা-বাবা বলে ডাকেন। সে-ই এখন আমাদের শেষ সম্বল। আমি তো এই সেবাশ্রমের শুরুর দিক থেকে আছি। এখানো ভালো আছি।
বিমাকর্মী রাজেকা রহমানের দেবী চৌধুরানী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়েছে ২০১৮ সালের দিকে। এর পরের বছরই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নতুন জমিতে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাজ শুরু করা জয়। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি স্থানীয় দানশীল ব্যক্তিরাও এগিয়ে আসে রাজেকার মহৎ এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়ার মিঠাপুকুরে রাজেকা রহমানের জন্ম। মিঠাপুকুরের সংগ্রামপুরের স্থানীয় একটি স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করেন। ১৯৯৯ সালে চৌধুরানী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পড়েছেন পীরগাছা কলেজেই। বিয়ে করেছেন চাচাতো ভাই মিজানুর রহমানকে। তাদের সংসারে একটাই ছেলেসন্তান, আল মুবিন ইসলাম রাতুল। সে রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। রাজেকার কাছে সংসার বলতে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মা-বাবারাই এখন সব।
এমএসআর/এনএ