মাইকেল জ্যাকসনের মতো নেচে চানাচুর বিক্রি
মাইকেল জ্যাকসনের মতো নেচে নেচে কমেডি করেন নাসির। মাইকেল জ্যাকসনের মতোই পোশাক পরেন তিনি। শুধু নাচ দেখানোই তার কাজ নয়, নেচে নেচেই তিনি বিক্রি করেন চানাচুর। ভোলার গাড়িঘাটা খায়েরহাট এলাকায় তার বাড়ি। সংসারে তার দুই ভাই ও তিন বোন রয়েছে। তার বাবা কখনো কখনো খেতে কাজ করেন। বৃদ্ধ হওয়ায় বেশিরভাগ সময় তার বাবাকে ঘরেই থাকতে হয়।
আগে হোটেলে কাজ করতেন নাসির। হোটেলের থালাবাসন মাজা, কাস্টমারদের খাবার দেওয়া— এটা ছিল তার কাজ। ভালোই চলছিল নাসিরের সংসার।
হঠাৎ নাসিরের জীবনে নেমে এল অন্ধকার। হোটেলমালিকের খারাপ আচরণ তার ভালো লাগেনি। প্রতিবাদ করায় মালিকের অর্ডার ‘কাইল হইতে আর কাজে আওনের দরকার নাই।’ এরপর আর জিদ করে কাজে যায়নি নাসির।
কী করবে এখন ভাবতে লাগল নাসির? ঘরে ৫ ভাই-বোন ও মা-বাবা। কাজের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও কাজ পায় না নাসির। রিকশা চালাতে গিয়ে দেখে অনেক কষ্ট, ব্যর্থ হয় নাসির।
কী কইরা খাবে? বোন বিয়ে দিতে হবে, সংসারে বাজার নিতে হবে— এসব চিন্তা ঘুরপাক করে তার মধ্যে, বললেন নাসির। একদিন নাসির রাস্তায় ঘুরছেন কাজের জন্য, হঠাৎ সামনে দেখল এক চানাচুরওয়ালা।
‘কত টাকা বিক্রি হয়, প্রতিদিন কত লাভ থাকে? কাছে গিয়ে জানতে চাইলো নাসির। চানাচুরওয়ালা উত্তরে বলল ‘কোনো দিন ৪০০, কোনো দিন ৬০০; আবার জোকারি কইরা ঘুঙুর বাজাইয়া নাচ দিলে ৮০০-১০০০ টাকার চানাচুর বেচা যায়।’
সেই রাত থেকেই নাসিরের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কীভাবে বিক্রি করবে চানাচুর। মানুষ কী বলবে। সকালে উঠে একটি টেপ রেকর্ডার আর একটি মাইক সংগ্রহ করেন তিনি। কিছু টাকা ধার আর নিজের জমানো টাকা নিয়ে চানাচুরের বাক্স তৈরি করেন নাসির। কিনেন এই ব্যবসার নানা উপকরণ— চানাচুর, পেঁয়াজ, মরিচ, তেল, গরমসলা, লবণ।
এই সামান্য পুঁজি নিয়েই জীবনসংগ্রাম শুরু করেন নাসির। টাকা বেশি আয় করার জন্য নিজেকে বানায় ‘মাইকেল জ্যাকসন’। মাইকেল জ্যাকসনের মতো পোশাক পরে, পায়ে বাঁধে ঘুঙুর, চোখে গ্লাসছাড়া চশমা। সেই থেকে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু।
চানাচুরওয়ালা নাসির বলেন, ‘হোটেলে কাজ করে ইনকাম কম হয়, তাই পেশা বদলে মাইকেল জ্যাকসন চানাচুরওয়ালা হইছি। এখন মন স্বাধীন— ইচ্ছা হলে কাজ করি; ইচ্ছা না-হলে করি না। ছোটবেলায় সার্কাস দেখতাম আর এখন নিজেই জোকার হইয়া এই পোশাক পইরা অহন জীবন চালাই।’
‘কী করমু? জোকারের পোশাক কিনলাম, ঘুঙুর কিনলাম। বৃদ্ধ মা-বাবা ও দুইটা ভাতের জন্য জোকারের পোশাক পইরা রাস্তায় নামলাম।’ বললেন তিনি।
চানাচুর বিক্রি করে এক বোন বিয়ে দিয়েছেন নাসির। নাসির এই কাজ করেই এখন সংসার চালায়। হাসি মুখে বলেন, ‘বিয়ে করেছি, সন্তান হয়নি এখনো।’
কষ্ট নিয়ে মলিন মুখে নাসির বলে যান তার জীবনের কথা। কষ্টের কথা। নাসির বলেন, ‘আগে যখন ঘুঙুরের শব্দে চারপাশ থেইকা পোলাপান বয়স্করা চিল্লায় উঠে বলত, ‘ওই যে জোকার যায়’ তখন অনেক কষ্ট হইতো, গাছের আড়ালে যেয়ে কান্না করতাম।’
তাই টেপ রেকর্ডার কিনেছেন নাসির। এখন ‘ওই জোকার মামা, চানাচুর দাও’ বললে কষ্ট হয় না; গানের সুরে সব ভুলে যান নাসির।
ঘরে অভাব তাই নেচে গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে চানাচুর বিক্রি করি তিনি। প্রতিদিন ১০০০-১৫০০ টাকা বিক্রি হয়। যেদিন কম বিক্রি হয় সেদিনও ৮০০-৯০০ টাকা বিক্রি হয়। বিক্রির প্রায় অর্ধেক লাভ থাকে তার।
কষ্টের কথা বলতে বলতে এক সময় চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি আমারে একটু সহযোগিতা করত, আর ভালো লাগে না এই কাম করতে।’
এমএসআর